অথবা, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক কারণ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দাও।
উত্তর: ভূমিকা: ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৮৫৭সালের মহাবিদ্রোহ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে অনেক ঐতিহাসিক ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি পরবর্তী ১০০ বছরে সমগ্র ভারতবর্ষ গ্রাস করে এবং তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। সিপাহী বিদ্রোহ একদিনে জন্ম নেয়নি বরং এটি ছিল বহুদিনের তিলে তিলে সঞ্চিত প্রস্তুতির ফল।
অর্থনৈতিক কারণ: মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. তুমি ও ভূমি সংক্রান্ত নীতিমালা: ব্রিটিশদের ভূমি ও ভূমি ভারতীয় অর্থনীতির উপর চরম আঘাত হানে। বিশেষ করে সংক্রান্ত নীতি এবং এ সম্পর্কীত আইনবিধি ও প্রশাসন ব্যবস্থা রাজস্বনীতির ফলে এককালের সমৃদ্ধিশালী ভারতীয় কৃষককুদ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে, এমনকি ভূমিহীন শ্রমিকে পরিণত হয়। অতিরিক্ত কর ধার্য, ক্ষুদ্র জমিদারকে অবৈধভাবে তাদের ভূ সম্পত্তি হতে বিতাড়ন প্রভৃতি নীতি মহাবিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে।
২. কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস ও শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি: বিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন ও নীল চাষের মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতীয় কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস করে। উপরন্তু শিল্প জাত বিভিন্ন বিদেশি দ্রব্য আমদানি করে ভারতের শিল্প বিকাশের পথ রুদ্ধ করে। এভাবে কৃষি ও কুটির শিল্প ধ্বংসের পথে অগ্রসর হওয়ায় জনগণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে।
৩. জনগণের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য: প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি, বিভিন্ন পদ হতে ভারতীয়দের অপসারণ, রাজত্ব ও জমিদারদের প্রতি শোষণ দরিদ্রদের উপর বিত্তশালীদের অত্যাচার ও শোষণ প্রভৃতির ফলে কৃষক ও জামিদারসহ বিভিন্ন স্তরের জনগণের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র তাদের মধ্যে সঞ্চার করে এবং তা হতে উত্তরণের আশায় তারা মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
৪. ভারতীয় সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার: ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশ কর্মচারীরা এদেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করে। তারা স্বর্ণ, রৌপ্য ও মূল্যবান সম্পদসহ প্রচুর অর্থ ইংল্যান্ডে পাচার করে ব্রিটিশ অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলে।
ধর্মীয় কারণ: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ধর্মীয় কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. ভারতবাসীর ধর্মান্তরিত হবার ভীতি: বিদেশিয় সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি ভারতবাসীর মনে গভীর আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রকাশ্যভাবে ধর্মপ্রচার হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা এরূপ আশঙ্কার সৃষ্টি করে যে, ইংরেজদের উদ্দেশ্য হলো ভারতবাসীকে ধর্মান্তরিত করা। লর্ড ক্যানিং ভারতে আসেন এবং ভারতবাসীকে ধর্মান্তরিত করার জন্যই কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছেন।
২. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির উপর করারোপ: ব্রিটিশ শাসকরা মসজিদ; ও মন্দিরের খাস জমির উপর কর আরোপসহ ধর্মীয় ও দাত্তব্য সংস্থাগুলোর উপরও কর ধার্য করেছিল। তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য দানকৃত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে হিন্দু ও মুসলমানদের বিরাগভাজন হয়।
৩. ওয়াবী আন্দোলনের প্রভাব: মুসলমান সম্প্রদায়ের মনেও অনুরূপ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এরূপ আতঙ্ক হতেই ‘ওয়াবী’ আন্দোলনের উৎপত্তি হয়। ‘ওয়াবী’ আন্দোলন মূলত ধর্ম সংস্কার আন্দোলন হিসেবে উৎপত্তি লাভ করলেও অচিরেই এটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণতি লাভ করে।
সামরিক কারণ: ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সামরিক কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. ইংরেজ সৈন্যদের স্বল্পতা: নিজেদের যুদ্ধকৌশল স্বম্বন্ধে ভারতীয় সিপাহীদের উচ্চ ধারণা ছিল। তখন ইংরেজ সৈন্যদের কিছু অংশকে চীন ও পারস্যে প্রেরণ করা হয়। ফলে ভারতে অবস্থানরত ইংরেজ সৈন্যদের স্বল্পতা দেখে বিক্ষুদ্ধ সিপাহীরা বিদ্রোহী হতে উৎসাহিত হয়।
২. এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন: সেনাবাহিনীতে ‘এনফিল্ড রাইফেল’ নামে এক ধরনের অস্ত্র প্রচলন করা হয়। ভারতীয় সিপাহীদের মনে আশঙ্কা জন্মে যে, গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজের প্রচলন করে ব্রিটিশ সরকার হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সৈন্যদের ধর্মনাশের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ব্রিটিশ সামরিক কর্তৃপক্ষ সিপাহীদের পক্ষে কপালে তিলক কাটা, দাঁড়ি রাখা ও পাগড়ি পরিধান নিষিদ্ধ করে যা ভারতীয় সিপাহীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত হানে।
৩. মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহ ঘোষণা: ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুর সেনানিবাসে মঙ্গল পান্ডে নামে এক ব্রাহ্মণ সিপাহী প্রকাশ্যভাবে বিদ্রোহী হলে সমগ্র ভারতে মহাবিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। মঙ্গল পাণ্ডে উত্তেজিত হয়ে তাঁর উর্ধ্বতন ইংরেজ অফিসারকে আক্রমণ করে। তারপর বিদ্রোহ বিভিন্ন স্থানে সিপাহীদের ছাউনিতে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা ইংরেজদেরকে ভারত থেকে হটিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞা করে।
৪. ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া: ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজয় ভারতীয় সিপাহীদের মনে আশার সঞ্চার করে এবং ক্রমশ তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠে। ইংরেজদের বিতাড়িত করা যে নিতান্তই মহৎ ব্যাপার সিপাহীদের মনে এ ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে কেবল সিপাহী অভ্যুত্থান ছিল না বরং এটি ছিল বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। ভারতে বিদেশি শাসনের অবসান ঘটানোই ছিল এ অভ্যুথানের সুস্পষ্ট লক্ষ্য। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল বিদেশী শাসন উৎখাত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত এক জাতীয় আন্দোলন।