১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে স্বাক্ষরিত লক্ষ্ণৌ চুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী ছিল? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনের প্রারম্ভ থেকেই ভারতীয়রা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করেন। এক পর্যায়ে ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে কংগ্রেস তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন আলাদা জাতি হিসেবে মুসলমানরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ গঠন করে। এক পর্যায়ে দুটি
সংগঠন সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখা যায়, তাদের কারোরই মূল দাবিসমূহ পূরণ হচ্ছে না। তাই ১৯১৬ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ অধিকার আদায়ের সংকল্পে লক্ষ্মৌ শহরে একটি চুক্তি করে যা লক্ষ্মৌ চুক্তি নামে খ্যাত।

লক্ষ্ণৌচুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ: ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে বর্ণনা করা হলো-

১. যৌথভাবে আন্দোলন পরিচালনা : এ চুক্তি অনুযায়ী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যৌথভাবে ভারতে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করে।

২. প্রাদেশিক আইন পরিষদের গঠন : এ চুক্তিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোকে ঢেলে সাজাবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাদেশিক পরিষদগুলোর ১/৫ অংশ সদস্য হবেন মনোনীত এবং ৪/৫ অংশ সদস্য হবেন নির্বাচিত। বড় প্রদেশে সদস্য সংখ্যা ১২৫ জনের হবে না এবং ছোট প্রদেশে এ সংখ্যা হবে ৫০ থেকে ৭৫ এর মধ্যে।

৩. ভোটাধিকার সম্প্রসারণ : এ চুক্তির দ্বারা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটাধিকার সম্প্রসারণ করা হয়। মনোনীত সদস্য ব্যতীত বাকি সব সদস্যই জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয় এবং এ চুক্তিতে ভোটারের সংখ্যা যথাসম্ভব বৃদ্ধির কথা বলা হয়।

৪. আইন পরিষদে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব ও মুসলমানদের নির্দিষ্ট আসন:

(ক) ভারতের প্রধান প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আইন পরিষদে বিশেষ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকবে। ভারতের প্রধান প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আইন পরিষদে বিশেষ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকবে।

(খ) কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোতে আইন পরিষদের ক্ষেত্রে কংগ্রেস মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন মেনে নিবে। প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোতে নিম্নলিখিত সংখ্যানুপাতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তবে এ শর্ত থাকে যে, এসব নির্বাচিত আসন ছাড়া মুসলমানরা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অন্য কোনো আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। যেসব প্রদেশগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু যেসব প্রদেশে তারা সংখ্যানুপাতিক হারের বেশি আসন লাভ করবে। আর যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু সেখানকার আইন পরিষদে তুলনামূলক কম আসন লাভ করবে।

কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ৪/৫ অংশ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ১/৩ অংশ নির্বাচিত আসন পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলমানদের দেয়া হবে।

(গ) কেন্দ্রীয় আইন নির্বাচিত সদস্য।

(ঘ) আইন পরিষদের সদস্যদের দ্বারা পরিষদের president নির্বাচিত হবেন।

৫. স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিল প্রণীত হবে না : যে কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রাদায়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো বিল কখনোই পাস করা হবে না। যদি উক্ত সম্প্রদায়ের ৩/৪ অংশ সদস্য এ বিলের বিরোধিতা করে।

৬. গৃহীত প্রস্তাব সরকারের মান্য: আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা গৃহীত যে কোনো প্রস্তাব সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। তবে প্রয়োজনবোধে গভর্নর ভোট দিতে পারবেন।

৭. হস্তক্ষেপ ক্ষমতা: শান্তি স্থাপন, যুদ্ধ ঘোষণা এবং চুক্তি সম্পাদনসহ ভারতের সামরিকনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালন ক্ষমতায় আইন পরিষদ এর হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা বা অধিকার থাকবে না।

৮. সম্পর্কগত উন্নয়ন: ডোমিনিয়ন সরকারসমূহের সাথে ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশ মন্ত্রীর যে, সম্পর্ক ভারত সরকারের সাথে ভারত সচিবের সম্পর্কও অনুরূপ হতে হবে।

মূল্যায়ন: উপরের সার্বিক বিশ্লেষণ হতে স্পষ্ট যে, লক্ষ্মৌ চুক্তি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এটাই প্রথম ভারতের ভবিষ্যৎ সাংবিধান নীতির প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম তথা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভারতবাসীর দীর্ঘদিনের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে এ দুই রাজনৈতিক দল যৌথভাবে ব্রিটিশ সরকারের নিকট আবেদন জানায়। অবশ্য তাদের এ ঐক্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তথাপি তা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি ভারতের শাসনতান্ত্রিক উন্নয়নে এক অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল। এ চুক্তি ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ক্রমবিকাশে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এ চুক্তি হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ মিটিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ রচনা করেছিল। আর এ সম্প্রীতির ফলেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তাই বলা যায়, ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌচুক্তি ছিল হিন্দু-মুসলিম এক্য প্রতিষ্ঠার এক চমৎকার প্রচেষ্টা।