১৯৩৫ সালের আইনানুযায়ী ফেডারেল আইনসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ১৯৩৫ সালের আইনানুযায়ী ফেডারেল আইনসভার গঠন, ক্ষমতা আলোচনা কর। ও কার্যাবলি

উত্তর: ভূমিকা: ভারতের সাংবিধানিক বিবর্তনের ইতিহাসে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হলে ক্রমাগত গণ অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ব্রিটিশ সরকার এ গণ অসন্তোষ দূর করার লক্ষ্যে দীর্ঘ ১৬ বছর পর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করে।

ফেডারেল আইনসভার গঠন: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে কেন্দ্রে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠন করা হয়।
এ আইনসভার প্রথম কক্ষের নাম Legislative Assembly বা ব্যবস্থাপক সভা এবং দ্বিতীয় কক্ষ Council of state বা রাষ্ট্রীয় পরিষদ বলা হয়।

Council of state বা রাষ্ট্রীয় পরিষদ: ২৬০ জন সদস্য নিয়ে Council of state গঠিত। এটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার মধ্যে দ্বিতীয় কক্ষ। ২৬০ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৫৬ জন ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধি আর বাকি ১০৪ জন ছিলেন দেশীয় রাজন্যবর্গ দ্বারা মনোনীত। ব্রিটিশ ভারতের ১৫৬ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৫০ জন পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশসমূহ থেকে নির্বাচিত হয়ে আসতেন আর বাকি ৬ জন গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হতেন। সম্পত্তির ভিত্তিতে ১ লক্ষ ব্যক্তি ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ লাভ করে।
Council of state এর সদস্যরা ৯ বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। প্রতি ৩ বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসরে যেতেন এবং শূন্য আসনে নতুন সদস্য নির্বাচিত হতেন।

Legislative Assembly বা ব্যবস্থাপক সভা: ৩৭৫ জন সদস্য নিয়ে Legislative Assembly গঠিত। এতে ২৪৬ জন প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং ১২০ জন দেশীয় রাজ্যগুলোর রাজন্যবর্গ দ্বারা নির্বাচিত হতেন। অবশিষ্ট ৪ জন ভারতের বাণিজ্য, শিল্প ও শ্রম সংস্থাগুলোর দ্বারা নির্বাচিত হতেন। এ সভার মেয়াদকাল ছিল ৩ বছর। ১৯১৯ সালের আইন অনুযায়ী। ১৯৩৫ সালের আইনে তা ৫ বছর করা হয়। তবে প্রয়োজনে গভর্নর জেনারেল আইনসভা ভেঙে দিতে পারতেন। আইনসভার প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে এক স্পীকার বা সভাপতি নির্বাচিত হতেন।

ব্যবস্থাপক সভা এর ২৪৬ জন প্রতিনিধি প্রদেশ ভিত্তিক আসন বিন্যাস দেখানো হলো:

আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ভারতসভার হাতে প্রভূত পরিমাণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। যথা-

১. আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যাবলি: আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্ত সকল বিষয়ের উপর আইন প্রণয়ন করতে পারত। জরুরি অবস্থার সময়ে আইনসভা প্রাদেশিক বিষয়গুলোর উপর আইন প্রণয়ন করতে পারত। দেশীয় রাজ্যগুলো ফেডারেশনে অংশগ্রহণের দলিলে যে সকল বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের উপর অর্পণ করত সেসব বিষয়ের উপর ফেডারেল আইনসভা আইন প্রণয়ন করত। এছাড়া ভারতের যে কোনো অংশে বসবাসরত ব্রিটিশ প্রজা ব্রিটিশ ভারত এবং দেশীয় রাজ্যে রেজিস্ট্রিকৃত সকল জাহাজ, বিমান ও তার আরোহীদের উপর আইনসভার আইন প্রণয়ণ ক্ষমতা ছিল। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত যে কোনো আইনে গভর্নর ভেটো প্রয়োগ করতে পারতেন। অথবা রাজা বা রানীর জন্য সংরক্ষণ করতে পারতেন। এরূপ অনেক ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেলের প্রাধান্য ছিল। গভর্নর জেনারেল আইনসভার সম্মতি ছাড়া যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য অর্ডিন্যান্স বা জরুরি আইন জারি করতে পারতেন। তিনি তার সেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে গভর্নর জেনারেলের আইন প্রণয়ন করতে পারতেন। এতে দেখা যায় ফেডারেল আইনসভার ক্ষমতা নানাভাবে সীমিত করা হয়। এটা কখনো সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হতে পারত না। গভর্নর জেনারেলের ইচ্ছামাফিক আইনসভাকে চলতে হতো।

২. শাসন সংক্রান্ত কার্যাবলি: এ ব্যবস্থার মাধ্যমে দুই কক্ষের প্রশাসনিক ক্ষমতা এক ছিল না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা আইনসভার নিম্নকক্ষের কাছে দায়ী থাকতেন। নিম্নকক্ষে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা পাস হলে মন্ত্রিসভার পতন ঘটত। তবে কেন্দ্রীয় আইনসভার আস্থাভাজন হলে মন্ত্রিসভা বহাল থাকতে পারত। আইনসভা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে একজন মন্ত্রিকে অপসারণ করতে পারত। আইনসভার উপয়কক্ষ মন্ত্রিদের কাছে প্রশ্ন এবং অতিরিক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করে মন্ত্রীদের নাজেহাল করতে পারত। গভর্নর জেনারেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।

৩. অর্থসংক্রান্ত কার্যাবলি : আইনসভার অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। এ ব্যবস্থায় গভর্নর জেনালের প্রতি বছরের জন্য সরকারের বার্ষিক আয় ব্যয়ের হিসাব বা বাজেট আইনসভায় পেশ করার ব্যবস্থা করতেন। এ আর্থিক বিবরণীতে ভোটযোগ্য এবং ভোট বহির্ভূত বিষয়গুলো পৃথকভাবে দেখানো হতো। বাজেটের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যয় বরাদ্দ ছিল ভোট বহির্ভূত। এগুলো ছিল।

(ক) গভর্নর জেনারেলের বেতন, ভাতা এবং তার অফিস সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয়।

(খ) যুক্তরাষ্ট্রের উপর আরোপিত ঋণভার।

(গ) মন্ত্রী, উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা, এডভোকেট জেনারেল চীফ কমিশনারস, অর্থ-উপদেষ্টা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা।

(ঘ) যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত ও হাইকোর্টের বিচারকদের বেতন ভাতা ও পেনসন।

(ঙ) সংরক্ষিত বিষয় যেমন প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, উপজাতীয় এলাকা ও ধর্মীয় বিষয়ের ব্যাপারে গভর্নর জেনারেলের বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের ব্যয় সংস্থান।

(চ) যে কোনো প্রদেশের অধীন স্বতন্ত্র এলাকার প্রশাসনের জন্য ব্যয় বরাদ্দ।

(ছ) যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজস্ব থেকে ইংল্যান্ডের রাজার দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপনজনিত ব্যয় পরিশোধ।

(জ) ফেডারেল আইনসভার আইন অনুসারে অন্য যে কোনো ব্যয় নির্বাহ।

আইনসভার অর্থসংক্রান্ত আলোচনায় দেখা যায়, একে সীমিত করে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। কেননা দেখা যায় আইনসভায় মঞ্জুর না হওয়া কোনো বরাদ্দ দাবি গভর্নর জেনারেল তার বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য জরুরি মনে করলে তিনি নাচক হওয়া মঞ্জুরিকে বহাল করতে পারতেন। অর্থসংক্রান্ত আইনসভার ক্ষমতা সম্পর্কে Prof K.T.Shah মন্তব্য করেন, We can not but recognis that the field of finance open to the legislature is strictly limited. Even in the limited field every attempt is made to drown or centratise the voice of the chosen representative of the people in the lower house. At every stage in the counse of the passage of the annual budgat through the Federal legislatare. The governor-general is given powers of intervention. Suggestion and dictation. The last word rests with the gover nor general and his word shall prevail ever after the combined vate of the two chambers of the national legistature has decided a case agianst the suggestions of the government general.

মূল্যায়ন: ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করেন। এ আইনে যে আইনসভা গঠন করা হয় তা সার্বভৌম ছিল না। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা গঠিত হয় তা সত্যিকার অর্থে কোনো সার্ভভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা ছিল না। এরা ক্ষমতা এমনভাবে সীমিত করা হয় যে, সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় একে আইনসভা হিসেবে গণ্য করা যায় না। অর্থসংক্রান্ত এবং শাসনসংক্রান্ত বিষয়ের উপর আইনসভার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সংবিধান সংশোধন ক্ষমতাও আইন পরিষদের ছিল না। একমাত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টই সংবিধান সংশোধন করতে পারত। একদিক দেখা যায় যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কেবল ভারতীয় সংবিধান প্রণয়ন করেন নি। ভারতের জন্য আইন প্রণয়নেরও অধিকারী ছিলেন। এতে আইনসভার ক্ষমতা খর্ব করা হয়। ফলে আইনসভা গুরুত্বহীন হয়ে যায়। এ সম্পর্কে M.R Palande মন্ত ব্য করেন, The absense of financial power imported an air of unreality to the responsible government and tended to reduce it to a mockery.

উপসংহার: অতএব বলা যায়, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস ছিল একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। কারণ, এ আইন পাস করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের যুক্তি ছিল দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন দেয়া হবে। আইনসভার হাতে প্রভৃত ক্ষমতা দেওয়া হবে। কিন্তু ভারতবাসীর স্বার্থের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, এতে যে সকল প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় তার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি।