১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা কতটুকু উন্নততর ছিল সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা কতটুকু উন্নততর ছিল তুলনামূলক আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ভারতের সাংবিধানিক বিবর্তনের ইতিহাসে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তা বোধের উন্মেষ, রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ব্যর্থতার ফলশ্রুতি হলো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এ আইনটি পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মূলভিত্তি রচনা করে। এ আইনটি ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা অধিকতর উন্নত ছিল।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা কতটুকু উন্নততর ছিল: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের তুলনামূলক ব্যাখ্যার মাধ্যমে তা স্পষ্ট করা হলো:

১. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা বলা হলেও বাস্তবে প্রাদেশিক গভর্নরগণ শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির মত তাদের কাজ করত। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশগুলো স্বায়ত্বশাসনের অধিকার পায়, প্রদেশগুলো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা পায় এবং প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে, প্রাদেশিক সরকার ও আইন পরিষদের উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা হয়। প্রাদেশিক গভর্নর ও মন্ত্রিপরিষদ তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার নিকট দায়ী করা হয়, এবং প্রাদেশিক গভর্নরগণকে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

২. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা: ১৯১৯ সালের আইনে সীমিত স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা থাকলেও সমূদয় ক্ষমতা মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই রয়ে যায়। প্রাদেশিক গভর্নরগণ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রদেশগুলো পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে এ সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। এর ফলে আইন ও শাসন সংক্রান্ত বিষয়াদি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে বিভক্ত করা হয় এবং কেন্দ্রের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়া হয়। ১৯১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনের ধারণা দেয়া হলে ১৯৩৫ এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।

৩. কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের কথা থাকলেও তা হয়নি। এ ব্যর্থতাকে অবলোকন ও পর্যালোচনা করে ব্রটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের আইনের মাধ্যমে প্রদেশে দ্বৈতশাসন রহিত করে কেন্দ্রে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে প্রশাসন ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনয়ন করাই ছিল এর লক্ষ।

৪. দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তন করা হয়। দায়িত্বশীল শাসনের ক্ষেত্র ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। কিন্তু এ আইন কেন্দ্রে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যেগ গ্রহণ করেনি। কিন্তু ১৯৩৫ সালের আইন দ্বারা কেন্দ্রে দায়িত্বশীল সরকারের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিগণ আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন। আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিগণ পদত্যাগ করতে বাধ্য থাকতেন। ১৯১৯ সালের আইনের অধীনে এরূপ দায়িত্বশীলতার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পক্ষান্তরে ১৯৩৫ সালের আইনের মাধ্যমে শুধু কেন্দ্রেই নয় প্রদেশগুলোতেও দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়, যদিও তা যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি।

৫. দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইন পরিষদ: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে প্রাদেশিক আইনসভা এক কক্ষের স্বেচ্চাচারে পরিণত হয়। এ স্বেচ্ছাচারিতা রোধকল্পে ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে অধিকাংশ প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা হয়। এতে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলো এক কক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত হয়।

৬. শাসন বিষয়সমূহের বণ্টন নীতি: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সরকারি বিষয়গুলোকে দুভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। যথা- কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়সমূহ এবং প্রাদেশিক তালিকাভুক্ত বিষয়সমূহ। সরকারের কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এবং প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের আংশিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পক্ষান্তরে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে সরকারি বিষয়গুলোকে তিনটি বিভিন্ন তালিকায় বিভক্ত করা হয়; যেমন (i) কেন্দ্রীয় তালিকা (ii) প্রাদেশিক তালিকা (iii) যুগ্ম তালিকা।

কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক, এবং যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক সম্মিলিতভাবে শাসিত হবে বলে নির্ধারণ করা হয়। এভাবে সরকারের বিষয়গুলোকে তিনটি তালিকায় বিভক্ত করে তিনটি ভিন্ন উপায়ে তাদের শাসন করার ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে ১৯১৯ সালের আইন অপেক্ষা উন্নততর ছিল।

৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত প্রতিষ্ঠার কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৫ সালের আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন – সরকারের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করাই ছিল এ আদালতের প্রধান কাজ। কিন্তু ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলের বিচার কমিটিই ছিল আপিলের চুড়ান্ত আদালত।

৮. ভোটাধিকার বৃদ্ধি: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে জনগণের ভোটাধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু ১৯৩৫ সালের আইন দ্বারা ভোটাধিকার আরও প্রশস্ত ও বিস্তৃত করা হয়। ফলে ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বহুগুণ। প্রশাসন ব্যবস্থায় জনগণ পূর্বের চেয়ে অধিক পরিমাণে অংশগ্রহণের সুযোগ লাড করে।

৯. উপদেষ্টা সংস্থা: ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করতেন। প্রয়োজন বোধে তিনি প্রাদেশিক শাসনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেটের ঐতিহাসিক কাউন্সিলের বিলুপ্তি ঘটিয়ে এর স্থলে অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন একটা উপদেষ্টা সংস্থা গঠন করে।

তুলনামূলক আলোচনার মূল্যায়ন: ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের তুলনামূলক আলোচনা হতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯১৯ সালের আইন ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতবাসীকে জাতীয় প্রশাসন পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়ার যে ব্যবস্থা করে তাই ১৯৩৫ সালের আইন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা যথেষ্ট উন্নত ছিল। যদিও এ আইন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে ভারতে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা কোনো দিনই কার্যকর হয়নি। বিশেষ করে গভর্নর জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরের হাতে বিশেষ ক্ষমতা প্রদানের ফলে কেন্দ্র বা প্রদেশ কোনো ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, এত সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতি ও বিবর্তনের ক্ষেত্রে ১৯৩৫ সালের আইনের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না। এ আইন ১৯৩৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার পূর্বপর্যন্ত ভারতে প্রবর্তিত ছিল। বস্তুত, এ আইনের বাহুধারা পরবর্তীকালে পরিবর্তন ও পরিবর্ধিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে গৃহীত হয়।