১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৪৭ সালের ‘ভারত স্বাধীনতা আইন’ অনুযায়ী ভারতকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ করা হয় এবং জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের। কংগ্রেসের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সম্ভাব্য ভারতের স্বাধীনতাকে সামনে রেখে ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেলেও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ সে লক্ষ্যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি। ফলে পাকিস্তানের জন্ম হলেও সংবিধান প্রণয়ন একটি বড় সমস্যা হিসেবে থেকে যায়। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হলেও এখানে ভাষা ও প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ে একটি সংকট দেখা দেয়। অন্যদিকে, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের পকেট রাজনীতি এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা সংকটকে আরো তীব্র করে তোলে। অবশেষে ডাযাগত সমস্যার অবসানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে তা কার্যকর হয়। ১৯৫৬ সালের পাকিতান সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ: ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান

সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:

১. প্রস্তাবনা: ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের মূল সুর বুঝানোর উদ্দেশ্যে এর প্রথমেই একটি প্রস্তাবনা ছিল। এই সংবিধানে ৬টি তফসিল, ১৩টি অনুচ্ছেদ এবং ২৩৪টি ধারা ছিল।

২. ইসলামি প্রজাতন্ত্র: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সংবিধানে উল্লেখ করা হয় যে, ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি অবশ্যই একজন পাকিস্তানি মুসলমান হবেন। তিনি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি নির্বাচনি সংস্থা বা Electoral college যারা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। দুবারের বেশি এক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারবেন না। এই সংবিধানে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন প্রণয়নও নিষিদ্ধ করা হয়।

৩. ফেডারেল রাষ্ট্র: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকার ও ফেডারেট বা প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ছাড়াও যুগ্ম তালিকাভুক্তদের হাতেও আংশিক ক্ষমতা অর্পণের কথা এ সংবিধানে উল্লেখ করা হয়।

৪. সরকার ব্যবস্থা: ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের কেন্দ্র ও প্রদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সংসদীয় বা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান এবং শাসনতন্ত্র লংঘন বা অসদাচরণের জন্য তাকে অভিযুক্ত করা যেত। অন্যদিকে, মন্ত্রিপরিষদ তাদের কাজের জন্য আইন পরিষদের নিকট দায়ী ছিলেন।

৫. এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা: ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে একটি এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তিত হয় যা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নামে পরিচিত ছিল। ১০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ এই জাতীয় পরিষদে মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩১০টি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমসংখ্যক সদস্য গৃহীত হওয়ার কথা এই সংবিধানে উল্লেখ ছিল।

৬. রাষ্ট্রভাষা: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু।

৭. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রদেশের শাসন পরিচালনার জন্য প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত একজন গভর্নরের কথা উল্লেখ থাকলেও তাকে সহায়তা করার জন্য একটি নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারের কথা বলা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি অন্যান্য মন্ত্রীদের নিযুক্ত করবেন। তবে গভর্নর প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, মুলতবি অথবা ভেঙে দিতে পারবেন বলে উল্লেখ ছিল।

৮. বিচার বিভাগ: ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের অহেতুক যাবতীয় হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। এতে বলা হয় যে, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হবে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের নিয়ে। ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত বিচারপতিগণ দায়িত্বে নিযুক্ত থাকতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়। প্রদেশগুলোর জন্য আলাদা হাইকোর্টের বিধান রাখা হয়। এতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্ট তা মীমাংসার এখতিয়ার রাখে।

৯. মৌলিক অধিকার: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানী নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো সন্নিবিষ্ট করা হয়। সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারসমূহের নিশ্চয়তা প্রদানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের উপর। মৌলিক অধিকারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হবার সুযোগ তৈরি করে দেবার কথাও এই সংবিধানে উল্লেখ করা হয়।

১০. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়। এই নির্বাচন কমিশনের কাজ হবে নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা।

১১. নমনীয় সংবিধান: ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধান অনেকটা নমনীয় ছিল। এতে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ সংবিধান সংশোধন করতে হলে সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হলেই চলবে। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই সংবিধানের সংশোধনটি কার্যকর হতে হলে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন ছিল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চলা পকেট রাজনীতি আর গোলযোগের পর ১৯৫৬ সালে প্রথম পাকিস্তানে সংবিধান রচিত হয়। এই সংবিধান ছিল পাকিস্তানী জনগণের কাছে অনেকটা আশার প্রদীপ এবং গণতান্ত্রিক পদক্ষেপের প্রথম সোপান। তবে পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতিতে এর কার্যকর হওয়া বেশ কঠিন ছিল। সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর তা আরো উন্নীত না হয়ে বরং পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যায় এবং ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান এক সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ১৯৫৬ সালের সাংবিধানিক শাসনের সমাপ্তি ঘটান।