১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির ফলাফল আলোচনা কর।

অথবা, পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

উত্তরা। ভূমিকা: পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, শাসন ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাহীনতা, আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য, অপরিসীম দুর্নীতি, জনগণের অভাব অনটন ও নিরাপত্তাহীনতা দেশে ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। কেন্দ্র ও প্রদেশে মন্ত্রিসভার দ্রুত রদবদল হতে থাকে। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এ সুযোগে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তান সামরিক শাসন জারি করেন। যার ফলাফল বা প্রভাব বহুদিন পর্যন্ত এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়।
ফলাফল: ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল নিচে আলোচনা করা হলো:

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারির ফলে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই লক্ষ্য করা যায়। এর সমর্থকরা একে স্বাগত জানায় এবং এক নতুন যুগের সূচনা হিসেবে অভিহিত করে। তারা একে স্বর্গীয় এবং শান্তিপূর্ণ বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করেন। অন্যদিকে, অধ্যাপক কে. জে. নিউম্যান (K. J. Newman) ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনকে ‘A Preventive Autocracy’ বা ‘প্রতিশোধকমূলক স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন (S. P. Hantington) আখ্যায়িত করেছেন, ‘সংস্কারমূলক অভ্যুত্থান’ হিসেবে। আর অধ্যাপক খালিদ বিন সায়ীদ একে পাকিস্তানের শাসন পদ্ধতি ভেঙে যাওয়া এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থার পতন হিসেবে অভিহিত করেছেন। পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলে আমরা যেসব সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করি এগুলো নিম্নরূপ:

১. সংবিধান বাতিল: ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলে ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে আইয়ুব খান তার নিজ ইচ্ছামতো একটি সংবিধান সৃষ্টি করেন।

২. রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ: জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলো ভেঙে দেন এবং সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। যার ফলশ্রুতিতে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়।

৩. রাজনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা: আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে এক নিত্য নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করার পরিকল্পনা হাতে নেন এবং ১৯৬২ সালে প্রণীত সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু করেন।

৪. একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা: আইয়ুব খান সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত করে এমন শাসন পদ্ধতি চালু করেন, যাতে সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব বিলীনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তার শাসন আমলে পাকিস্তানে অর্থনীতি বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি এক চরম অবস্থায় পতিত হয়।

৫. সরকার বিরোধী আন্দোলন: সামরিক সরকার এক পর্যায়ে বেসামরিকীকরণের প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে চায় জনগণ তা সমর্থন করেনি। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি পেশ করলে ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। সরকার দমননীতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ‘আগরতলা মামলা’ দায়ের করে। গণজাগরণ গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয় এবং আইয়ুব সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

৬. সামরিক হস্তক্ষেপের সূচনা: ১৯৫৮ সালের সামরিক আইন জারির মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের ধারা সূচিত হয়। এ ধারা উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও প্রভাবিত হয়। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও এর প্রভাব লক্ষ করা যায়।

৭. গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত: সামরিক শাসন জারির ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা দীর্ঘদিনের জন্য পিছিয়ে পড়ে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনায় বলা যায় যে, পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সূত্রপাত কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটা অনেকাংশে পাকিস্তানের ‘৪৭ সাল থেকে ‘৫৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী সরকার ব্যবস্থার ব্যর্থতাও দায়ী ছিল। কারণ শাসনতান্ত্রিক নিয়মানুযায়ী গণতান্ত্রিক শাসন যেখানে কার্যকরী হতে বা স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয় সেখানে সামরিকবাহিনী সুযোগ গ্রহণ করবে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটাই হয়েছিল।