১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব লিখ।

উত্তর। ভূমিকা: পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, অর্থনৈতিক শোষণ, জাতিগত নিপীড়ন ও প্রশাসনিক বঞ্চনা পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে ক্রমান্বয়ে অসন্তুষ্ট করে তুলেছিল। এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন সেই কর্মসূচিই ৬ দফা কর্মসূচি নামে খ্যাত। ১৯৬৬ সালের ছয়-দফা আন্দোলনের পটভূমি:

নিচে ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে
আলোচনা করা হলো:

১. সামাজিক প্রেক্ষাপট: একই রাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যকার ব্যবধান ছিল বিস্তর। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উত্থিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বাঙালি জাতিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ হতে মুক্তি লাভের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে। ফলে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন।

২. রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হয় এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু স্বার্থবাদী পশ্চিম পাকিস্তানি গোষ্ঠী যুক্তফ্রন্টকে কৌশলে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে তাদের শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। বাঙালিদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও শোষণ ছয়দফার অন্যতম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

৩. অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখানো হয়। পাকিস্তানের বৈদেশিক আয়ের ৭০ শতাংশ আসত পূর্ব পাকিস্তান হতে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজকোষে জমা হতো মাত্র ২৫ শতাংশ। বাকি অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য খরচ করা হতো।

৪. ধর্মীয় প্রেক্ষাপট: পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তৃতীয় শ্রেণির মুসলমান, ভারতের দালাল, নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদের জাত বলে তাদের প্রতি চরম অবহেলা দেখাতো। এরূপ ধর্মীয় অবজ্ঞা ছয়দফার অন্যতম ধর্মীয় প্রেক্ষাপট।

৫. জাতীয়তাবোধ তৈরি: ছয়দফা প্রচারে বাঙালিদের মধ্যে এক অনুপম জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে থাকে। “বাঙালিরা শোষিত হচ্ছে” এ বেদনা বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে। এ সম্পর্কে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি’ প্রবন্ধে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, “বাঙালি জাতীয়তাবাদের চালিকা শক্তি হিসেবে ৬ দফা চূড়ান্ত জিম্মাদারে পরিণত হয়”।

৬. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি: পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী প্রাদেশিক গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন; প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের গঠন, দায়িত্ব বণ্টন ও কার্যকাল নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে কেন্দ্রই সকল শাসনতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতো। তাই কেন্দ্র হতে পৃথক হয়ে স্বাধিকার বা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয় ছয়দফা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে।

ছয়দফা আন্দোলনের গুরুত্ব: নিচে ছয়দফা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করা হলো:

১. প্রথম লিখিত প্রতিবাদ: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শাসক ও শাসিত নীতিকে শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট করেন। এছাড়া দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যনীতি সম্বন্ধে জনগণকে লিখিত রূপে জানান দেয়। সাম্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাক শাসক আইয়ুব খানের কাছে এ দাবি পেশ করা হয়। ছয়দফা শোষকের হাত থেকে শাসিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার। ছয়দফা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ নিয়ে গঠিত বাঙালি স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতার চাবিকাঠি হিসেবে।

২. পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ: ছয়দফা দাবির মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমা শাসকচক্রের ঘাঁটিতে আঘাত হানে। ছয়দফা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে সরকারের টনক নড়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি দলগুলোর মধ্যে বিরূপ মনোভাব দেখা যায়। আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেন। মোনায়েম খান বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।

৩. সরকারের দমননীতি: শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি পেশ করার পর সরকার বুঝতে পারে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কি চায়। তাই আইয়ুব সরকার দমন পীড়ন শুরু করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করলে ঢাকা শহরে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ মে “প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। ৭ জুন আওয়ামী লীগ হরতালের ডাক দেন। সরকার হরতাল বন্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলে সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। এতে ১০ জন নিহত হন।

৪. আগরতলা মামলা: শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি পেশ করলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে দমন করার চেষ্টা করে। তারা সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের দমন করার জন্য আগরতলা মামলা নামে একটি মামলা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের নামে পেশ করেন। এ মামলা করার পর সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে। তবে এ মামলা বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এ মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়।

৫. স্বায়ত্তশাসনের পথ প্রশস্ত: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবির প্রথম দফা দাবি ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন যা লিখিতভাবে পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা আবাস ভূমির প্রস্তাব করা হয়। তবে এ স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ ছিল না। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল সরকার এটা দমন করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়।

৬. বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: ছয়দফা ছিল মূলত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ ৬ দফার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শাসকবর্গ যে বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করেন তার প্রতিবাদ জানানো হয়। এক্ষেত্রে প্রকাশ্যে বৈষম্য যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ছিল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়। তবে সরকার এটা অবগত করা হলেও অতি সহজে সফল হওয়া যায়নি। এজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।

৭. হত্যাযজ্ঞ সৃষ্টি: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবি উত্থাপন করলে, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী দমন পীড়ন, নির্যাতন শুরু করে। এ সময় আন্দোলন আরো তীব্র হলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে আসাদুজ্জামান, শামসুজ্জোহা প্রভৃতি ব্যক্তিত্ব নিহত হন। এভাবে মানুষ হত্যা করতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পিছ পা হয় না।

৮. আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত: ১৯৬৬ সালের ছয়দফার শেষ দফা দাবি ছিল আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের ১৭ দিনব্যাপী যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এতে শেখ মুজিবুর রহমান ধারণা করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা সেনাবাহিনী বা সামরিকবাহিনী দরকার। কিন্তু পশ্চিমা গোষ্ঠীরা বলেন ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করলে আমরা দিল্লি দখল করবো।

৯. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান: ১৯৬৬ সালের ছয়দফার ভিত্তিতে আইয়ুব খান শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করেন। এতে বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীরা ভারতের ত্রিপুরায় আগরতলায় মিলিত হয় ও নিয়মিত ভারতীয় হাইকমিশনের সাথে যোগাযোগ রাখে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌমিত্ব খর্ব করার জন্য। আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে পূর্ব বাংলায়) জনরোষ সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়।

১০. আইয়ুব সরকারের পতন: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবি পেশ করা হলে আইয়ুব খান তা প্রতিহত করার জন্য দমনপীড়ন নীতি গ্রহণ করে। জনগণও এতে আবারও ক্ষেপে যায়। আগরতলা মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে জনগণের তীব্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। এতে করে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।

১১. বাংলাদেশের বীজ নিহিত: ঐতিহাসিক ছয়দফা ছিল বাঙালিদের বাঁচার দাবি। এ দাবি পূরণ করতে তারা দেয় বুকের তাজা রক্ত। ৬ দফার মাধ্যমে বাঙালির সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটে। ১৯৭১ সালে যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাঙালিরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন, তার বীজ ও ৬ দফার মাধ্যমে রোপণ করা হয়েছিল। রওনক জাহান বলেছেন, ৬ দফা বাঙালিদের স্বাধীনতার দলিলপত্র। অনেকের মতে, আজকের যে স্বাধীন বাংলাদেশ তার ভিত্তি ছিল ৬ দফা।

১২. আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবি উত্থাপনের আগে আওয়ামী লীগ এককভাবে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী যুক্তফ্রন্টে চারটি দলের সমন্বয়ে বিজয়ী হয় কিন্তু ১৯৬৬ সালের ছয়দফা এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এ দয়দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। তাই এদিক থেকে আওয়ামী লীগের জন্য ৬ দফা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা বাঙালির জীবনে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ ছয়দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, আঞ্চলিক সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়। আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য বুঝতে পারে তাই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার ও দমন নীতি ব্যবহার করে। কিন্তু সকল চেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়। ১৯৬৬ এর ছয়দফা দাবির উপর ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন সবশেষে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়।