১৯৬৬ সালে ছয়দফা দাবির গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবির তাৎপর্য আলোচনা কর।

অথবা, ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, ছয়দফা কর্মসূচি কী? বাংলার ইতিহাসে এর গুরুত্ব লিখ।

উত্তরঃ ভূমিকা: বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ছয়দফা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ, নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে বাঙালির জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছ্যাদফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের এক কনভেনশনে এ প্রস্তাব পেশ করেন। ছয়দফা প্রস্তাবকে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালির মুক্তিসনদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

ছয়দফা দাবির উদ্ভব: পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিদের উপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশোষক চত্রের শোষণ ও নির্যাতন। পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলে বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাঁচামালের যোগানদাতা অঞ্চল এবং একটি উপনিবেশ। যে গুটিকয়েক শিল্প কারখানা পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এর লভ্যাংশ ও পুঁজি তারা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করতো। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে সুষ্ঠু এ অর্থনৈতিক বৈষম্য বাঙালি জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। বাঙালি জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। স্বায়ত্তশাসনকামী বাঙালি জনগণের উপরে এভাবে অত্যাচার নির্যাতন বৃদ্ধি পেলে বাঙালি সংস্কৃতির উপর নগ্ন আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র শুরু হলে, শোষণ বঞ্চনা বৃদ্ধি পেলে, বৈষম্য বৃদ্ধি পেলে, সামরিক ক্ষেত্রে অরক্ষিত হলে বাঙালি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি ‘তাসখন্দ চুক্তি’ ভারত-পাকিস্তান এর মধ্যে হলে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১৯৬৬ সালের ৫-৬ তারিখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নেজামে ইসলামি দলের নেতা মোহাম্মদ আলীর লাহোরস্থ বাসভবনে সম্মেলন করেন। মোহাম্মদ আলী বলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করা যুক্তিযুক্ত হবে না। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা উত্থাপন করেন। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলাম শেখ মুজিবুরের দাবির বিরুদ্ধাচরণ করেন। এ সময় ৭ ফেব্রুয়ারি বিবরণ ছাপা হয় তরুণ সমাজ প্রচার করে “বাঙালির দাবি ছয়দফা” “বাঁচার দাবি ছয়দফা” পোস্টার লাগানো হয়। ঢাকার প্রায় সকল স্থানেই দেয়ালে পোস্টার সেঁটে দেয়া হয়।

ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবিসমূহ: শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত যে ছয়দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। নিচে সেই সকল দাবি আলোচনা করা হলো:

১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি;
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা;
৩. মুদ্রা বা অর্থ সংক্রান্ত।
৪. রাজস্ব কর ও শুল্ক সংক্রান্ত ক্ষমতা।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা।
৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা।

১৯৬৬ সালের ৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য: ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। এ দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন কামনা করা হয়। এছাড়া দুই পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ করা হয়। নিচে ৬ দফা দাবির তাৎপর্য আলোচনা করা হলো:

১. প্রথম লিখিত প্রতিবাদ: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শাসক ও শাসিত নীতিকে শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট করেন। এছাড়া দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যনীতি সম্বন্ধে জনগণকে লিখিত রূপে জানান দেয়। সাম্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাক শাসক আইয়ুব খানের কাছে এ দাবি পেশ করা হয়। ছয়দফা শোষকের হাত থেকে শাসিতের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার। ছয়দফা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ নিয়ে গঠিত বাঙালি স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভরশীলতার চাবিকাঠি হিসেবে।

২. পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আক্রমণ: ছয়দফা দাবির মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমা শাসকচক্রের ঘাঁটিতে আঘাত হানে। ছয়দফা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে সরকারের টনক নড়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি দলগুলোর মধ্যে বিরূপ মনোভাব দেখা যায়। আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেন। মোনায়েম খান বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।

৩. সরকারের দমননীতি: শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা দাবি পেশ করার পর সরকার বুঝতে পারে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কি চায়। তাই আইয়ুব সরকার দমন পীড়ন শুরু করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করলে ঢাকা শহরে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ মে “প্রতিবাদ দিবস” পালিত হয়। ৭ জুন আওয়ামী লীগ হরতালের ডাক দেন। সরকার হরতাল বন্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলে সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। এতে ১০ জন নিহত হন।

৪. আগরতলা মামলা: শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি পেশ করলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে দমন করার চেষ্টা করে। তারা সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের দমন করার জন্য আগরতলা মামলা নামে একটি মামলা শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের নামে পেশ করেন। এ মামলা করার পর সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে। তবে এ মামলা বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এ মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়।

৫. স্বায়ত্তশাসনের পথ প্রশন্ত: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবির প্রথম দফা দাবি ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন যা লিখিতভাবে পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা আবাস ভূমির প্রস্তাব করা হয়। তবে এ স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ ছিল না। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল সরকার এটা দমন করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়।

৬. বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: ছয়দফা ছিল মূলত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ ৬ দফার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শাসকবর্গ যে বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করেন তার প্রতিবাদ জানানো হয়। এক্ষেত্রে প্রকাশ্যে বৈষম্য যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ছিল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়। তবে সরকার এটা অবগত করা হলেও অতি সহজে সফল হওয়া যায়নি। এজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।

৭. হত্যাযজ্ঞ সৃষ্টি: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবি উত্থাপন করলে, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী দমন পীড়ন, নির্যাতন শুরু করে। এ সময় আন্দোলন আরো তীব্র হলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে আসাদুজ্জামান, শামসুজ্জোহা প্রভৃতি ব্যক্তিত্ব নিহত হন। এভাবে মানুষ হত্যা করতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পিছপা হয় না।

৮. আঞ্চলিক নিরাপতা নিশ্চিত: ১৯৬৬ সালের ছয়দফার শেষ দফা দাবি ছিল আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের ১৭ দিন ব্যাপী যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এতে শেখ মুজিবুর রহমান ধারণা করে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা সেনাবাহিনী বা সামরিকবাহিনী দরকার। কিন্তু পশ্চিমা গোষ্ঠীরা বলেন ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করলে আমরা দিল্লি দখল করবো।

৯. ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান: ১৯৬৬ সালের ছয়দফার ভিত্তিতে আইয়ুব খান শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করেন। এতে বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীরা ভারতের ত্রিপুরায় আগরতলায় মিলিত হয় ও নিয়মিত ভারতীয় হাইকমিশনের সাথে যোগাযোগ রাখে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব খর্ব করার জন্য। আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে পূর্ব বাংলায় জনরোষ সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়।

১০. আইয়ুব সরকারের পতন: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবি পেশ করা হলে আইয়ুব খান তা প্রতিহত করার জন্য দমনপীড়ন নীতি গ্রহণ করে। জনগণও এতে আবারও ক্ষেপে যায়। আগরতলা মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে জনগণের তীব্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। এতে করে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।

১১. বাংলাদেশের বীজ নিহিত: ঐতিহাসিক ছয়দফা ছিল বাঙালিদের বাঁচার দাবি। এ দাবি পূরণ করতে তারা দেয় বুকের তাজা রক্ত। ৬ দফার মাধ্যমে বাঙালির সামর্থ্যের প্রকাশ ঘটে। ১৯৭১ সালে যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাঙালিরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন, তার বীজ ও ৬ দফার মাধ্যমে রোপণ করা হয়েছিল। রওনক জাহান বলেছেন, ৬ দফা বাঙালিদের স্বাধীনতার দলিলপত্র। অনেকের মতে, আজকের যে স্বাধীন বাংলাদেশ তার ভিত্তি ছিল ৬ দফা।

১২. আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা: ১৯৬৬ সালের ছয়দফা দাবি উত্থাপনের আগে আওয়ামী লীগ এককভাবে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী যুক্তফ্রন্টে চারটি দলের সমন্বয়ে বিজয়ী হয় কিন্তু ১৯৬৬ সালের ছয়দফা এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এ দয়দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। তাই এদিক থেকে আওয়ামী লীগের জন্য ৬ দফা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা বাঙালির জীবনে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ ছয়দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, আঞ্চলিক সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়। আইয়ুব সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য বুঝতে পারে তাই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার ও দমন নীতি ব্যবহার করে। কিন্তু সকল চেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়। ১৯৬৬ এর ছয়দফা দাবির উপর ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন সবশেষে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়।