অথবা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন স্তর আলোচনা কর।
উত্তরা। ভূমিকা: ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যে সকল গণআন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনকেই কেবল গণঅভ্যুথানরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের সকল জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৬৯ সাল এবং এর পূর্ববর্তী ঘটনাবলি গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি রচনা করেছিল। এ গণঅভ্যুত্থানের কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম স্তর বলা যেতে পারে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন পর্যায়: ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে পূর্ব পাকিস্তানের উপর অত্যাচার-নিপীড়নের সূচনা করেন। ফলে বাংলার মানুষের মধ্যে দানা বেঁধে উঠে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, যা ১৯৬৯ সালে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন পর্যায় নিম্নরূপ:
১. পাক-ভারত যুদ্ধ: ১৯৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধে সামরিক শক্তির সবটুকু ব্যবহার করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অথচ পূর্ব পাকিস্তানকে রাখা হয় সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ফলে জনমনে পাকিস্তান বিদ্বেষ গড়ে উঠে।
২. আগরতলা মামলা: ১৯৬৮ সালে ৬ দফাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জটিলতায় পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের নামে যড়যন্ত্রমূলকভাবে আগরতলা মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ফলে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান।
৩. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার। তারা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে সংস্কৃতমনা বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
৪. ভাষা সংস্কার: ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং বাংলার পরিবর্তে রোমান অক্ষরে লেখার প্রচলন করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রবল বিরোধিতার মুখে তারা পিছু হটে।
৫. ১১ দফা ঘোষণা: ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্ররা ৬ দফার আলোকে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে, যা বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের জন্য বিশেষভাবে আবশ্যক ছিল।
৬. গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন: ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জামায়াতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট একত্রে আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। তারা ৮ দফা ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে নামে।
উপর্যুক্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলি গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরি করে। মওলানা ভাসানী ১৪ জানুয়ারি হাতিরদিয়ায় স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের জন্য কঠোর মনোভাব পোষণ করে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করার হুমকি দেন। এদিকে ৬, ১১ ও ৮ দফা বাঙালিকে উজ্জীবিত করে। ১৭ জানুয়ারি ছাত্ররা ১১ দফা নিয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং পুলিশ বাধা দেয়। ফলে ১৮ জানুয়ারি আবারও ধর্মঘট ডাকা হয়। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান শহিদ হলে সারাদেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। লক্ষ লক্ষ জনগণ রাস্তায় নেমে পড়ে এবং ২১ তারিখ আবার হরতাল ঘোষণা করা হয়। এখানেও পুলিশ গুলি করে। ২১ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত মিছিল ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলে। ২৪ তারিখ লক্ষ লক্ষ জনগণ রাস্তায় নেমে আসলে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয় মতিযুর, রুস্তম প্রমুখ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আইয়ুব খান আলোচনার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করে, রাজবন্দিদের জেলে রেখে কোনো আলোচনা হবে না। ১২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঢাকা ত্যাগ করলে ‘ডাক’ ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হরতাল দেয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।
১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহাকে সেনাবাহিনী হত্যা করে। ফলে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ভেঙে জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। তিনি ১১ দফাকে সমর্থন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোলটেবিল বৈঠকে ৬ দফা ও ১১ দফা প্রশ্নে রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনায় বসেন কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হয়। ফলে পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়। সিভিল সমাজ অস্থির, উত্তেজিত ও বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। মোনায়েম খানের অপসারণের জন্য হরতাল আহবান করা হয়। ২২ মার্চ ড. এম.এন. হুদাকে নতুন গভর্নর নিযুক্ত। করা হয়। ২৫ মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। সমাপ্তি ঘটে আইয়ুব খানের শাসনকাল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সমাজের সফল উত্থান ঘটেছিল, যা কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ দ্বারা আটকানো যায়নি। আপামর জনসাধারণ এ অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল সমস্ত স্বার্থচিন্তার উর্ধ্বে উঠে এক জাতীয়তাবাদী চেতনায়। ফলে, গণ-অভ্যুত্থানে সফলতা এসেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ অভ্যুত্থান সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।