অথবা, ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বাহিনীর নারী নির্যাতনের একটি চিত্র তুলে ধর।
উত্তর। ভূমিকা: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার স্পৃহায় জাগ্রত বাঙালি জাতিকে পদানত করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণহত্যার পাশাপাশি নারীনির্যাতন চালিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষ নারীকে জীবন দিতে হয়েছে। বাংলার মা-বোনের রক্তাক্ত দেহের উপর দিয়েই এসেছে বাংলার স্বাধীনতা।
১৯৭১ এর হানাদার কর্তৃক নারীনির্যাতন: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা গণহত্যার পাশাপাশি বেছে নেয় নারীদের প্রতি পাশবিক ও সর্বপ্রকারের নির্যাতনের পথ। স্বাধীনতার জন্য অপরিসীম মূল্য দিতে হয়েছে নারীসমাজকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা কতটা বর্বর ছিল, কতটা পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠেছিল, কি পরিমাণ বিজাতীয় ক্রোধ ও জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে বাংলাদেশের অসহায় নারীদের প্রতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল, বর্বরোচিতভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল তার কোনো পরিমাপ করাই দুষ্কর। মুনতাসীর মামুন বলেন, “ধর্ষিতা বা নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সে সময় বিদেশি প্রতিবেদনেও এ সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের মতো বলা হয়েছে, ডাঃ জিওফ্রে ডেভিসও যে সংখ্যা দিয়েছিলেন সাম্প্রতিক গবেষণায় তাও সঠিক মনে হয় না। ‘বীরাঙ্গনা ১৯৭১’ শীর্ষক গবেষণা করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এর সংখ্যা আনুমানিক ৬ লক্ষের কাছাকাছি।”
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক জঘন্যতম নারীনির্যাতনের যে বিবরণ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়, তা যেন পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্বে সংঘটিত সকল পাশবিকতার দৃষ্টান্তকে স্নান করে করে দেয়। রফিকুল ইসলামের ‘নরহত্যা ও নারীনির্যাতনের কড়চা ১৯৭১’, আসাদুজ্জামানের ‘আমাদের একাত্তরে গণহত্যা ও নারীনির্যাতন’, এবং ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দলিলপত্র’ ১৯৭১ সালে সংঘটিত নারীনির্যাতনের যে চিত্র পাওয়া তা লোমহর্ষক।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে নারীনির্যাতনের চিত্র: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারীনির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘নরহত্যা ও নারীনির্যাতনের কড়চা ১৯৭১’ এ এক মর্মবিদারক চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
নিচে নারীনির্যাতনের একটি চিত্র তুলে ধরা হলো:
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ঝাড়ুদার হিসেবে কর্মরত রাবেয়া খাতুনের ভাষ্য মতে, পাঞ্জাবি সৈন্যরা রাজাকার ও আল-বদর দালালদের সাহায্যে রাজধানীর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং অভিজাত জনপদ থেকে বহু বাঙালি যুবতী নারী, রূপসী মহিলা, সুন্দরী বালিকাদের জিপে, মিলিটারি ট্রাকে করে পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে জমায়েত করতে থাকে। অধিকাংশ মেয়ের হাতে ছিল বইখাতা। পুলিশ লাইন থেকে পাঞ্জাবি সেনারা কুকুরের মতো জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের ভিতর প্রবেশ করে প্রতিটি যুবতী মহিলা ও বালিকাদের বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে। উন্মত্ত এ পাঞ্জাবি সৈন্য শুধু ধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয়নি ধারালো দাঁত বের করে বক্ষের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিচ্ছিল… সমস্ত দেহ অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিল। অনেক পাঞ্জাবি সৈন্য ছোটো বালিকাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের অসাড় রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দু’জনে দু’পা দু’দিকে টেনে ধরে ছিঁড়ে ফেলে। অনেককে আবার বিবস্ত্র মেয়েদের লাথি মারতে মারতে, পিটাতে পিটাতে হেডকোয়ার্টারে দোতলা, তেতলা ও চারতলায় বিবস্ত্র অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসব্যাপী সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা যেসব পন্থায় নিরীহ বাঙালি মহিলা, যুবতী ও কিশোরীদের ধর্ষণ ও নিষ্ঠুরতম নির্যাতন করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বহু মা-বোনের ইজ্জত সম্ভ্রম আর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক যে বর্বর নির্যাতন হয়েছিল তা ১৯৪২ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর নিধনযজ্ঞের চেয়েও ভয়ঙ্কর, ভিয়েতনামে আমেরিকা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত মাইলাই হত্যাকাণ্ডের চেয়েও নির্মম ও পাশবিক।