১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের ভূমিকা বর্ণনা কর।

অথবা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের প্রভাব বর্ণনা কর।

উত্তরা। ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোররা অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৮ বছরের কম বয়সের মুক্তিযোদ্ধাদের হার ছিল মোট মুক্তিযোদ্ধার ৩২.৬%। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ সকল শিশু কিশোররা গেরিলা আক্রমণ, পাকবাহিনীর খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরবরাহ, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ বাহিনীর তৎপরতা মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত। কখনো কখনো তারা অতর্কিত আক্রমণ করত পাকবাহিনীর উপর।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের ভূমিকা : নিচে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো:

১. সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেক শিশুকিশোর সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলন, ছয়দফা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের অংশ দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক শিশু কিশোর মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে শিশু কিশোররা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।

২. মুক্তিবাহিনীতে যোগদান: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোররা সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে যোগ করে। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর ভয়ে ও নিরাপত্তার অভাবে শিশু কিশোরগণ মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশু কিশোররা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতন ও গণহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

৩. যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ: শিশু কিশোররা যুদ্ধক্ষেত্রে সংবাদ সরবরাহ করত। পাকবাহিনীর অবস্থান, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ বাহিনী দৌরাত্ম্য, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি খবর সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর নিকট পৌঁছে দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের পথ চিনিয়ে দিয়ে নিরাপদ চলাচলের ব্যাপারে সাহায্য করত।

৪. মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রূষা প্রদান: শিশু কিশোররা মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তিবাহিনীদের সেবা শুশ্রূষা প্রদান করত। বিভিন্ন রকমের চিকিৎসাজনিত সেবা প্রদান করত শিশু কিশোররা। যুদ্ধকালীন সময়ে সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সকল হাসপাতালে কিশোরীরা সেবিকা হিসেবে গৌরবময় ভূমিকা রাখে।

৫. প্রতিশোধ গ্রহণ: মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরগণ পাকবাহিনী ও এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থি বাহিনীর উপর প্রতিশোধ গ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। রাজাকার বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে, তার প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে।

৬. অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ ও মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছানো: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরগণ মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মেনেড সরবরাহ করত। রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিত। তাদের অসীম সাহসিকতা মুক্তিবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

৭. স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ: পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে সর্বস্তরের সাধারণ জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধে শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয় মাত্রায়।

৮. আত্মত্যাগ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের আত্মত্যাগ ছিল সর্বোচ্চ ত্যাগ। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে গিয়ে বুলেটের আঘাতে অসংখ্য শিশু কিশোর প্রাণ হারায়। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা ও অসংখ্য শিশু কিশোর নিহত হয়। যুদ্ধের খবর সরবরাহকালে রাজাকার ও পাকবাহিনীর ঢাতে ধরা পড়ে অনেক শিশু কিশোর আত্মহত্যা করেছে।

৯. ভীতি প্রদর্শন: শিশু কিশোরগণ রাজাকার, আল-বদর, শাস্তি কমিটি ও আল-শামস্ বাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতির কথা বলে সবসময় ব্যতিব্যস্ত রাখত। অনেক সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করত শিশু কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা।

১০. নির্যাতন ও নিপীড়ন ভোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী ও এদেশীয় পাকবাহিনীর সহযোগীদের দ্বারা অনেক শিশু কিশোর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শিশু কিশোরদের ধরে অমানবিক নির্যাতন করে মুক্তিবাহিনীর খোঁজখবর জিজ্ঞাসা করত পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনী। এছাড়া কিশোরদের ধরে নিয়ে যেত ক্যাম্পে এবং সেখানে নিয়ে তাদের উপর পাকিস্তানি বাহিনী অমানবিক ও নৃশংস নির্যাতন করত কখনো তাদের ধর্ষণ করা হতো।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শিশু কিশোরদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন শহীদুল ইসলাম। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। সকল প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে অসীম সাহস নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছে শিশু কিশোররা। শিশু কিশোরদের আত্মত্যাগ মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসামান্য অবদান চিরকাল বাংলার মানুষ শ্রদ্ধাচিতে স্মরণ করবে।