অথবা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্ব বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সর্বশ্রেণির মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ত্বরান্তিত হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা: কোনো দলের একক প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেনি। এর অন্তরালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। দল, মত নির্বিশেষে সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ত্যাগতিতিক্ষা ছাড়া স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। নিচে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আলোচিত হলো:
আওয়ামী লীগের ভূমিকা : যাটের দশকের ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয় ও
প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাঙালি জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াবহ কালরাত্রির পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে সমবেত হন। ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়। সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মীদের ভারতে প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করে। প্রশিক্ষণ শেষে দলীয় কর্মীরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে যে সমর্থন দিয়েছিল সে সমর্থনের উপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়।
বামপন্থি দলগুলোর ভূমিকা: ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থি দলগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধে যে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেয় তাদের দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
ক. মস্কোপছি বাম দল ও
খ. পিকিংপন্থি বাম দল।
মস্কোপছি বাম দলগুলোর ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে মস্কোপন্থি বাম দলগুলোর ভূমিকা ছিল লক্ষ্যণীয়।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) এবং এর অঙ্গসংগঠনসমূহ যথা: কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র প্রভৃতি। উল্লিখিত দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পৃষ্ঠপোষকতায় এ দলগুলো নিজস্ব গেরিলা বাহিনী গঠন করে এবং হাজার বিশেক গেরিলাকে মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ১৯৭১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এন. এল. এফ) গঠনের প্রস্তাব করেন। সমাজতান্ত্রিক দেশ ও অন্যান্য প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সমর্থন লাভ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য বাংলাদেশ প্রবাসী সরকার তাতে সম্মত হয়নি বরং ৯ সেপ্টেম্বর এটা একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনে সম্মত হয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মণি সিং, মোজাফফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর, তাজউদ্দিন আহমদ এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ কমিটির সদস্য ছিলেন। উক্ত কমিটি তিন ধরনের দায়িত্ব পালন করতো।
ক. স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করা;
খ. মস্কোর সমর্থন লাভ করা এবং
গ. বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য কোনো সমাধান বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না এ কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করা।
পিকিংপছি বাম দলগুলোর ভূমিকা: পিকিংপস্থি বাম দলগুলোও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদান রাখে। এসব দলের মধ্যে ন্যাপ ভাসানী, কো-অর্ডিনেশন কমিটি অব কমিউনিস্ট রেভোলিউশনারিজ (সি. সি. সি. আর), কমিউনিস্ট ওয়ার্কস অ্যাসোসিয়েশন (সি ডব্লিউ এ), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (বি. সি. পি), পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন বাসার গ্রুপ), কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র (অমল সেনের নেতৃত্বে) এবং পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী/লেনিনবাদী) উল্লেখযোগ্য। এসব দল ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) কর্তৃক সমর্থনপুষ্ট এ কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন মওলানা ভাসানী।
অন্যান্য পিকিংপন্থি দলের ভূমিকা: উল্লিখিত পিকিংপন্থি দলগুলো ছাড়াই আরো কয়েকটি পিকিংপন্থি দলের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এসব দলের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন- আলাউদ্দিন গ্রুপ), পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মূলত দেশের সর্বস্তরের জনগণের সমর্থনের উপর ভর করে রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তান বিরোধী যে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল তারই চূড়ান্ত ও চরম অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। আর এর ফলশ্রুতিতে আমরা পাই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।