অথবা, মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাথমিক ও সাংগঠনিক প্রতিরোধ সম্পর্কে পর্যালোচনা কর।
অথবা, মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রশাসনিক প্রতিরোধ সম্পর্কে একটি নিবদ্ধ রচনা কর।
উত্তর। ভূমিকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষিতে সর্বাত্মক হরতাল পালনের পাশাপাশি সর্বত্র কালো পতাকা উত্তোলন, মিছিল, সমাবেশ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও বামপন্থি দল অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করে। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে পূর্ব প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা ছাড়াই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ প্রতিরোধ করে। প্রতিরোধ হয়েছে ছাত্র, তরুণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কৃষক ও শ্রমিকের মাধ্যমে। পরবর্তীতে সশস্ত্রবাহিনীর বিদ্রোহী সদস্যরা যোগ দিয়ে প্রতিরোধকে শক্তিশালী করেন।
বীর বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত প্রাথমিক প্রতিরোধ: ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে সর্বস্তরের জনতা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৫ মার্চ এর পূর্বেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালিরা। যথা:
১. সাধারণ জনতার তীব্র প্রতিরোধ: যশোরে পাকিস্তানি সেনাদল সাধারণ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। যশোর সেনানিবাসে ১০৭ ব্রিগেডের পাকিস্তানি সেনাদল এলাকা নিয়ন্ত্রণে আনে। পাকিস্তানি সেনাদল ঝিনাইদহ, ঈশ্বরদী ও বেনাপোল অভিমুখে যাত্রা করে। তারা যশোর থেকে ছয় মাইল অতিক্রম করার আগেই মারমুখী জনতার তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী কুষ্টিয়া এসে পৌছায়। এ দিন সান্ধ্য আইনভঙ্গ করে জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। রনি রহমান পাক সেনাদের গুলিতে এখানে প্রথম শহিদ হন। ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা বেনাপোল যশোর বিমানবন্দর এলাকায় আটকে পড়ে।
২. আহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে শ্রমিকের অস্বীকার: পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ বোঝাই জাহাজ এমডি সোয়াত চট্টগ্রাম এসে পৌঁছালে সেখানকার শ্রমিকরা অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃতি জানায়।
৩. জয়দেবপুরে প্রতিরোধ: পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ হয় জয়দেবপুরে। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ শুধু গাজীপুরে নয় সারা দেশের সার্বিক স্বাধীনতার সংগ্রামে তাৎপর্যপূর্ণ। ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের আগেই জয়দেবপুরের জনতা গর্জে উঠে। জয়দেবপুরে রেলক্রসিং এব কাছে লাঠি, তীর, বন্দুক ছাড়াও ব্যক্তিগত কয়েকটি বন্দুক নিয়ে জনতা উপস্থিত হয়। সেদিন জনতার অনুরোধে ৫ জন বাঙালি সৈনিক পাঞ্জাবি সৈনিকদের উপর প্রথম গুলি ছোঁড়ে।
৪. রাজারবাগে প্রতিরোধ: পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, নারী যাকে যেখানে পেয়েছে তাকেই নির্বিচারে হত্যা করেছে। পিলখানার ইপিআর এর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং দলীয় কার্যালয়সহ পুরোনো ঢাকায় আক্রমণ চালায়। রাজারবাগে প্রায় ১০০০ বাঙালি পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
৫. জিয়াউর রহমানের প্রতিরোধ : চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জিয়াউর রহমান প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে ১,০০০ রিক্রুট বাঙালি সৈন্যকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী চট্টগ্রামে ধর্ষণ, লুটপাট ও গণহত্যা শুরু করলে মেজর জিয়া চট্টগ্রামে এসে তার অধীনস্থ সৈন্যদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান। জিয়া তাঁর ব্যাটালিয়ানসহ কালুরঘাটে অবস্থান গ্রহণ করেন।
৬. কালুরঘাটে প্রতিরোধ: চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ২৯ মার্চ মুক্তি যোদ্ধাদের কালুরঘাট প্রতিরক্ষা অবস্থান আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। ১১ এপ্রিল কালুরঘাটে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
৭. কুমিল্লা প্রতিরোধ: পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করলে মুক্তিবাহিনী তাদের উপর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিবাহিনী ভারী মেশিনগান ও মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। ইপিআর সৈন্যরা কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যামবুস করে। ১৫২ জন পাক সৈন্য এ যুদ্ধে নিহত হয়। কুমিল্লা প্রতিরোধে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে।
৮. কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধ: ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী কুষ্টিয়া আক্রমণ করে। এ সময় কয়েক হাজার ইপিআর, সৈন্য, স্বেচ্ছাসেবক এবং ছাত্র সংঘবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানিদের উপর আক্রমণ করে। হাজার হাজার মানুষ দাও, সড়কি, বর্শা বা বল্লম প্রভৃতি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
৯. রাজশাহীতে প্রতিরোধ: পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল রাজশাহীতে। ২৮ মার্চ পাক সৈন্যরা আকস্মিকভাবে পুলিশ লাইনে আক্রমণ চালিয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালি হত্যা করে। গণহত্যার খবর রাজশাহীতে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ, ইপিআর ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রাজশাহীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
১০. সিলেট ও মৌলভীবাজারে প্রতিরোধ: সিলেট ও মৌলভীবাজারে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল শক্তিশালী। ২৭ মার্চ মৌলভীবাজারে পাঞ্জাবি সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় তারা মিয়া ও জমির মিয়া। মনু নদীর ব্রিজের সামনে অন্য এক প্রতিরোধ যুদ্ধে শহিদ হন লুন্দুর মিয়া শমসের নগরে ভাঙা ট্রেনের ওয়াগন দিয়ে রেললাইনে ব্যারিকেড গড়ে তোলে বাঙালিরা। এখানে পাক বাহিনীর একজন মেজর নিহত হয়। শমসের নগরে বহু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এরপর ২৫ দিন মৌলভীবাজার হানাদার মুক্ত থাকে।
১১. টাঙ্গাইলে প্রতিরোধ: ২৬ মার্চ টাঙ্গাইলে যুদ্ধকে সুসংগঠিত করতে গড়ে উঠে স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ।
লতিফ সিদ্দিকী ছিল গণবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ। এছাড়া কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একদল সাহসী তরুণ সার্কিট হাউস দখল করে নেয়। এপ্রিলের ২ তারিখে পাকবাহিনীর একটি বড় দল দেড়শ গাড়ি নিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে আসার সময় প্রতিরোধ বাহিনী আক্রমণ চালালে প্রায় ৩০০ পাক সেনা নিহত হয় এবং ২৫টি গাড়ি ধ্বংস হয়। কাদেরিয়া বাহিনীর প্রায় ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও ৭১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ এবং পরবর্তী নির্দেশানুযায়ী হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছে। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের মুখে বাঙালি ইপিআর, পুলিশ এবং ছাত্র জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিরোধ যুদ্ধ এগিয়ে যায়। প্রথম দিকে অপরিকল্পিতভাবে প্রতিরোধ হলেও পরবর্তীতে পরিকল্পিতভাবে প্রতিরোধ শুরু হয়। মে মাসে পরিকল্পিতভাবে সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলে পর্যুদস্ত হতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। শেষ পর্যন্ত সংগ্রামী বাঙালি জাতির জয় হয়।