অথবা, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার তাৎপর্য উল্লেখ কর।
অথবা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ এর ভাষণ স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা-বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর। ভূমিকা: বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অনন্য ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সমগ্র বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল এদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক ও প্রেরণার উৎস। পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের অধিকার আদায় ও ন্যায়সংগত দাবি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ছিল অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন বাঙালিদের মধ্যমণি, তার স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিল। নিচে স্বাধীনতা ঘোষণার গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো:
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা : বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের প্রশাসন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলন দমন করার জন্য পাক হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর গণহত্যা শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণার গুরুত্ব: বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হবার পরপরই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনতা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৬ ও ২৭ মার্চ রাজধানী ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সমগ্র বাঙালি মুক্তির নেশায় পাক বাহিনীকে প্রতেরাধ করতে রাস্তায় নেমে পড়ে।
২. সংগঠিত প্রতিরোধ: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রথম দিকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ হয়। কিন্তু মূল প্রতিরোধ শুরু হয় বাঙালি সৈনিকদের দ্বারা ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসারদের প্রতিরোধ। সম্মিলিতভাবে এ সংগঠিত প্রতিরোধ পাকিস্তানি শক্তিশালী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে।
৩. যুদ্ধের প্রস্তুতি: বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। তারপরই শুরু হয়ে যায় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এ প্রস্তুতির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। হানাদার বাহিনীর নিকট থেকে দেশ রক্ষার্থে পূর্ব বাংলার জনতা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিল।
৪. সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা: বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সমন্বিতভাবে এদেশের সাধারণ জনতার সাথে একত্রে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সামরিক বেসামরিক প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধে সুপরিকল্পিত ভীত রচনা করেছিল। যা পরবর্তীতে একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আকার ও রূপ নেয়।
৫. বহির্বিশ্বের সমর্থন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা এবং যৌক্তিকতা বহির্বিশ্বের কাছে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে বহির্বিশ্ব জানতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে তা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। দি টাইমস এবং দি গার্ডিয়ান নামক বিখ্যাত পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রকাশিত হয়। ফলে বিশ্ববাসী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখে। পরবর্তীতে বহির্বিশ্ব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিল।
৬. সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু: বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পূর্ববাংলার জনতার মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দেশের সর্বত্র জনতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে একাগ্রতা পোষণ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব দ্বারা সমগ্র পূর্ববাংলার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণায় সাড়া দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাস পূর্ববাংলার নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী চরম ত্যাগ স্বীকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের টনিক হিসেবে কাজ করেছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পূর্ববাংলার মুক্তির দিশারি, অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণার ফলে পূর্ববাংলার জনতা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র।