অথবা, মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী সমস্যা সংক্ষেপে লেখ।
উত্তর। ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় অধ্যায় ছিল শরণার্থী ইস্যু। এ শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে ক্রমে জড়িয়ে গেছে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো, ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহ, ভারত সরকার এবং এর জনগণ। ধীরে ধীরে বিশ্বের ছোটো থেকে বড় রাষ্ট্রগুলোর সরকার জনগণ সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে এ মানবিক ট্র্যাজেডির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা নিচে উপস্থাপন
করা হলো:
১. শরণার্থী সংখ্যা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঠিক কতসংখ্যক শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল সে সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১১ নভেম্বর জার্মানির বনে এক বক্তৃতায় ১৭ লক্ষ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
২. শরণার্থীদের আবাসন: শরণার্থীদের থাকার নির্দিষ্ট কোনো স্থান ছিল না। ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর হাসপাতাল, স্কুল এবং সকল সরকারি দালান শরণার্থীদের ভিড়ে জনাকীর্ণ হয়ে যায়। মাসের পর মাস বন্ধ থেকেছে স্কুল কলেজ। কর্তৃপক্ষ খোলার উদ্যোগ নিলেও বাধা দিয়েছে অভিভাবকরা, এ বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকে আশ্রয়হীন করে সন্তানের পড়ালেখা অব্যাহত থাকুক তারা তা চায়নি।
৩. শরণার্থীদের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান: প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন সম্পূর্ণ মানবতাবোধে তাড়িত হয়েই। পরবর্তীতে রাজ্যসরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘শরণার্থীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী, অর্থসংগ্রহ এবং জনমত তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
৪. শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে ভারতের স্বতঃস্ফূর্ততা: মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে দেশজুড়ে শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য সহানুভূতি ও সমর্থনের ঢেউ বয়ে যায়। ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী এক কথায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার তাগিদ অনুভূত করে।
৫. শরণার্থী সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন কমিটি গঠন: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশ সহায়তা কমিটি গড়ে উঠে। এ সমস্ত কমিটির মধ্যে ৩ এপ্রিল গঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক কমিটি। ৭ এপ্রিল নেহেরু ইউনিভার্সিটির অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ কমিটি গড়ে তোলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারিগণ। সরকারি আর্থিক সহায়তা প্রদান ছাড়াও তারা জনমত তৈরি এবং তহবিল সংগ্রহে কাজ করেছিল।
৬. শরণার্থী সমস্যা ও ভারতে সংকট: ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে শরণার্থী সমস্যা নানা ধরনের সংকট তৈরি করেছিল। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও বহু জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়। ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রী পর্যায়ের মিটিংয়ে এ সমস্যা সমাধানের জন্য সুস্থিরভাবে এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা এবং শরণার্থীদের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
৭. শরণার্থী সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি: ভারতের সব রাজনৈতিক দলই শরণার্থী বিষয়ে সরকারের ঢিলেঢালা নীতির সমালোচনা করে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ দলগুলো শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা প্রদানের দাবি জানায়। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে কলেরা মহামারি আকার ধারণ করলে তারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা খুবই প্রকট আকার ধারণ করেছিল। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার যোগান দেওয়া ভারতের মতো রাষ্ট্রের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। তারপরও ভারত সরকার ও জনগণের আন্তরিকতার ফলে কিছুটা হলেও শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।