অথবা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর্বগুলো উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র তরুণসহ আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে বিচ্ছিন্ন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ শুরু হয়। পরবর্তীতে ছাত্র, কৃষক, জনতা, শ্রমিকরা বিদ্রোহী সমস্ত বাহিনীর সাথে যোগ দিলে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পিত ভিত রচিত হয়। নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়গুলো আলোচনা করা হলো:
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়: মুক্তিযুদ্ধ বিশ্লেষক সুব্রত রায় চৌধুরী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ৫টি পর্যায়ে বিভক্ত করেন। যথা:
প্রথম পর্ব: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি সম্প্রদায়ের উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে বাঙালিরা সর্বাত্মক প্রতিরোধ শুরু করে। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষিত হলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনতা লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র এবং কর্মরত বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ ও আনসারগণ তাদের স্ব-স্ব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করে। বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদসহ বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠে। প্রথম পর্বে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা ও অতর্কিত আক্রমণ করে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করে। এ পর্বে পাকিস্তানি সাজোয়া বাহিনী জনতার প্রতিরোধ দমন করতে সফল হয় এবং পাক বাহিনীর কাছে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে আশ্রয় নেয়। মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়।
দ্বিতীয় পর্ব: জুন-জুলাই মাসকে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব বলে। প্রথম পর্বে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। দ্বিতীয় পর্বে মুক্তিবাহিনী শক্তিসঞ্চয় করতে থাকে। শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়। গেরিলা তৎপরতা সাবোটাজ এবং অ্যামবুশ হয় তাদের মূল কৌশল।
বর্ষাকালীন এ সময়ে মুক্তিবাহিনী রাস্তাঘাট পুল ব্রিজ ধ্বংস, টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নষ্ট করে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে থাকে। এ সময় গেরিলা বাহিনী বহু পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা ও আহত করে।
তৃতীয় পর্ব: আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস চলে মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় পর্ব। এ পর্বে মুক্তিবাহিনী সক্রিয়ভাবে আক্রমণ করতে থাকে পাকবাহিনীর উপর। কৌশলগতভাবে মুক্তিবাহিনী এ সময় গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সীমান্ত অঞ্চলে ব্যতিব্যস্ত রাখে। মুক্তিবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বেশকিছু বড় ধরনের অভিযান সফলভাবে পরিচালনা করে। নিউইয়র্ক টাইমসের ম্যালকম ব্রাউন ৬ অক্টোবর এক সংবাদ প্রতিবেদনে জানান যে, ছয় আগস্ট থেকে শুরু করে বাংলাদেশ নৌ কমান্ডো বাহিনী মোট ১৬টি নৌযানকে ধ্বংস করে অথবা অচল করে দেয়। মুক্তিবাহিনী এ সময় দেশের নানা জায়গায় দখলে নেয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীসহ বিহারী দোসর ও রাজাকারদের হত্যা করতে থাকে।
চতুর্থ পর্ব: এ পর্বে মুক্তিবাহিনীর হাতে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে চলে আসে। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ভয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পে ও সেনানিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনী রাত্রিকালীন সময়ে গ্রামবাংলা দখলে’ রাখতে সক্ষম হয়। সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ব্যস্ত থাকায় দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ ছিল নিত্যদিনকার ব্যাপার।
পঞ্চম পর্ব বা শেষ পর্ব: মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্য বাহিনী দ্বারা মুক্তিযুদ্ধে যৌথবাহিনী গঠন ছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্ব। ২১ নভেম্বর যৌথবাহিনী গঠিত হয় এবং ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্ব। ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সর্বতোভাবে সমর্থন করতে থাকে। পাকিস্তান এ কৌশলের বিপরীতে ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিম সীমান্তে বিমান হামলা চালায়। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। পাক-ভারত অঘোষিত যুদ্ধ এবং ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যায়। যৌথবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় যে, যৌথবাহিনী দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যৌথবাহিনীর অভিযানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হতে থাকে। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখ হতে বাংলাদেশ ভারত যৌথবাহিনী একসাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। মাত্র ১৮ ঘন্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনী প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলায়। একের পর এক রণাঙ্গনে পরাজিত হতে থাকে পাকবাহিনী। বাংলাদেশের বিজয় হয়ে দাঁড়ায় সময়ের ব্যাপার। অবশেষে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে কাঙ্ক্ষিত দিন। ৯৩ হাজার সৈন্যসহ দখলদার পাকবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজী যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বাঙালি জাতির কাছে গৌরবের। দীর্ঘ ত্যাগ তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় এ কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। দীর্ঘ ৯ মাস ধাপে ধাপে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়গুলো ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।