অথবা, ১৯৭১ সালে যৌথবাহিনী গঠন ও স্বাধীনতা লাভ সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তরঃ ভূমিকা: পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাংলাদেশকে (পূর্ব পাকিস্তান) ভালো নজরে দেখেনি। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার মাধ্যমে। এর পরই শুরু হয় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির সর্বাত্মক যুদ্ধ। দীর্ঘ কয়েক মাস যুদ্ধ করার পর গঠিত হয় বাংলাদেশ ভারতের যৌথবাহিনী যার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অভ্যুদয় হয় ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির।
যৌথবাহিনী গঠন: ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের মধ্য থেকেই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার জন্য ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। ২১ নভেম্বর যুদ্ধকে একই কমান্ডের আওতায় আনা ও যুদ্ধকে বেগবান করার জন্য বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। মূলত মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়। লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশের রণাঙ্গনকে ৪টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর এ যৌথবাহিনীর কাছেই পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
যৌথবাহিনীর অভিযান: পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানঘাঁটি অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর ও আগ্রার উপর অতর্কিত বিমান হামলা চালালে সেদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
১. পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ আক্রমণ: বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথবাহিনী গঠনের পর ৪ ডিসেম্বর থেকে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়তে থাকে। অবশ্য ভারতকে একই সঙ্গে পশ্চিম রণাঙ্গনেও পাকিস্তানের সঙ্গে লড়তে হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর যে সামান্য কটি বিমান ছিল তা ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। মূলত ৬ ডিসেম্বর সূর্য উঠার আগে থেকেই কতকগুলো সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পাকবাহিনীর পিছু হঠা শুরু হয়।
২. যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ও সিলেট বিজয়: যৌথবাহিনীর আক্রমণে ৭ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে। পাক সেনারা ট্যাংক, কামান এবং ট্রাক-জিপ নিয়ে খুলনায় পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যে সিলেট শহরটিও যৌথবাহিনীর দখলে আসে। প্রথমে খুব ভোরে যৌথবাহিনীর ছত্রী সেনারা সিলেটের পাক ঘাঁটিগুলোর উপর আক্রমণ চালায়। দুপুর আড়াইটার মধ্যে সিলেটের পাক অধিনায়ক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
৩. ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ ও পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান: যৌথবাহিনী ৮ ডিসেম্বর ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট চারদিকে অবরোধ করে। যৌথ কমান্ডের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ পাকবাহিনীকে আত্মত্মসমর্পণের আহ্বান জানান এবং তাদের সাথে জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুসরণ করা হবে বলে জানান। তিনি পাক সেনাদের আরো সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, তাদের পালাবার সকল পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
৪. ঢাকা অবরোধ: যৌথবাহিনী ৯ ডিসেম্বর চতুর্দিক থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। তখন তাদের লক্ষ্য হয় দ্রুত ঢাকায় পৌছানো এবং ঢাকার পাকবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। ১০ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বিদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য বিমান আক্রমণ বন্ধ রাখা হয়। ঐ দিনই ভৈরব শহর হানাদার মুক্ত করা হয়
এবং সেখান থেকে ঢাকা শহর আক্রমণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
৫. অন্যান্য অঞ্চলকে হানাদার মুক্তকরণ: ১২ ডিসেম্বর চতুর্দিকে পাকবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। বহু পাক হানাদার ঘাঁটির পতন হয়। শত্রুমুক্ত হয় জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরিয়া, দুর্গাদিঘি, বিগ্রাম, চন্ডীপুর, পিসপাড়া প্রভৃতি অঞ্চল। অবস্থার শোচনীয়তায় গভর্নর ডাঃ এ. এম. মালিক তার মন্ত্রিপরিষদসহ পদত্যাগ করেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাতে কোনোরূপ সাহায্য না আসতে পারে সেদিকে ভারতীয় নৌবাহিনী প্রথম থেকেই বিশেষ নজর রাখছিল।
৬. টাঙ্গাইল মুক্তকরণ ও ঢাকায় হামলা: ১৩ ডিসেম্বর মুক্ত হয় টাঙ্গাইল। এদিকে ১২ ডিসেম্বরের নির্দিষ্ট সময় থেকে
পুনরায় ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকা নগরীর উপর হামলা চালাতে থাকে এবং ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। যৌথবাহিনী যতই ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং ঢাকার উপর বিমান হামলা যতই বাড়ছিল ঢাকায় পাক সমর নেতাদের অবস্থাও ততই কাহিল হয়ে উঠছিল। অবস্থার বেগতিক দেখে পাকিস্তানি জেনারেলরা বারবার ইসলামাবাদের কাছে সাহায্য পাঠাবার আবেদন জানায়। কিন্তু তাতে কোনো ফললাভ হয় না।
৭. সপ্তম নৌবহর ও নিয়াজির আশা ভঙ্গ: নিয়াজি সপ্তম নৌবহরের সাহায্য আশা করেছিলেন। কিন্তু সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে আসলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। যার ফলে নিয়াজি ১৩ অথবা ১৪ তারিখে বুঝে নেয় যে, সপ্তম নৌবহর তাকে সাহায্য করতে আসবে না। এতে তার আশা ভঙ্গ হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী একেবারে ভেঙে পড়ে। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজি ৯৩ হাজার সহযোগী নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পিছনে কারণসমূহ: পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পিছনে বেশ কতকগুলো কারণ বিদ্যমান ছিল।
১. গেরিলা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পাকবাহিনীর বিপর্যয়: ২৬ মার্চ থেকে বাঙালি যুবক, তরুণ, ইপিআর, সেনাবাহিনী ও পুলিশের অপরিকল্পিত প্রতিরোধ জুন মাস থেকে সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধের ফলে সুসংগঠিত হয়। তারা পাকবাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। অক্টোবর নাগাদ মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকবাহিনীর ২৩৭ জন অফিসার, ১৩৬ জন জেসিও এবং অন্যান্য শ্রেণির ৩,৫৫৯ জন সৈন্য নিহত হয়।
২. নৌ কমান্ডোদের আক্রমণ: স্থল যুদ্ধে পাকবাহিনীর বিপর্যয়ের পাশাপাশি বাঙালি নৌ কমান্ডোরা আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, নদী ও সমুদ্রবন্দরে ব্যাপক অভিযান চালায়। মুক্তিযুদ্ধের বড় ধরনের অভিযানে পাক বাহিনীর ১২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। তাছাড়া সেপ্টেম্বর থেকে চালনা ও চট্টগ্রামের বন্দরে কোনো বিদেশি জাহাজ আসতে রাজি হয়নি। এতে পাকবাহিনীর অস্ত্র ও রসদ সরবরাহে সংকট দেখা দেয়।
৩. বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের সফল কূটনৈতিক উদ্যোগ: বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবগত করতে বিভিন্ন মিশন করেন। ভারত ছাড়াও ৪টি মিশনসহ ১১টি প্রতিনিধিত্বকারী দপ্তর মুজিবনগর সরকার স্থাপন করে। অক্টোবরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলে ৮ নভেম্বর মার্কিন সরকার পাকিস্তানের অর্থ নিষেধাজ্ঞা বিল পাস করে। অন্যদিকে, ভারত মে মাস থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করে। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহ উচ্চপদস্থরাও বিদেশ সফর করেন। যার ফলে পাকিস্তান বহির্বিশ্বে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
৪. যৌথ কমান্ড: বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতের ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় যৌথ কমান্ড। যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করা হয়। এতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কি করবে বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।
৫. ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি: পাকিস্তানি বিমানবাহিনী অতর্কিতে ভারতের বিমানঘাঁটিতে হামলা চালালে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ভারত সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফলতার দিকে এগিয়ে যায়। এ সময় যৌথবাহিনী বিভিন্ন স্থানে হানাদার মুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং অনেক স্থানে অবরোধ করে রাখে। অবশেষে যৌথবাহিনী ঢাকা দখলের জন্য অগ্রসর হয়।
৬. পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চূড়ান্ত বিজয়: ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে বাংলার আকাশে ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় স্বাধীনতার সূর্যটি। লে. জে নিয়াজির নির্দেশে ভোর পাঁচটা থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। এ দিনই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জে. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি যৌথবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মোট ৯৩,০০০ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা আর কোরবানির নাম। মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস লক্ষ লক্ষ প্রাণবিসর্জন আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার লাল সূর্যটি। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিকে দমাতে পারেনি বরং তারাই বাঙালির কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। অবশেষে অভ্যুদয় হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।