১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের বৈধতার ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের বৈধতা সম্পর্কে তোমার যুক্তিপূর্ণ মতামত পেশ কর।

উত্তর। ভূমিকা: তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনৈতিক সমস্যাবলির মধ্যে অত্যন্ত প্রকট সমস্যা হলো বৈধতার সমস্যা। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করলেও এসব রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় Legitimacy বা বৈধতার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না। বাংলাদেশেও এ বিষয়টি প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিসংগ্রামের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয় এর বৈধতার ভিত্তি কী ছিল তা আলোচনার দাবি রাখে। কেননা স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত বৈধতার প্রশ্নটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বৈধতার প্রশ্নটি শাসনব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

১৯৭২ এর সংবিধানের বৈধতার ভিত্তি: বাংলাদেশের সংবিধানের বৈধতার ভিত্তি ছিল ঐকমত্য। এ ঐকমত্য যেভাবে গড়ে উঠেছিল তা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো:

প্রথমত, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষ থেকে মওলানা ভাসানী খসড়া সংবিধানের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং বলেছেন, “তদানীন্তন পাকিস্তানের আইনগত কাঠামো আদেশের অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য সদস্যগণ নির্বাচিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সাথে উক্ত নির্বাচনও বাতিল হয়ে গেছে এবং সে সাথে গণপরিষদও তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে।” কাজেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কোনো অধিকার এ গণপরিষদের নেই বললেই চলে। খসড়া সংবিধানে জনগণের চাহিদা ও মৌল অধিকার সংযোজন ঘটেনি। তিনি অবিলম্বে সরকারের খসড়া সংবিধানের উপর জনমত যাচাই করতে আহ্বান জানান।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (রব), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, কৃষক-শ্রমিক-পার্টি প্রত্যেকেই সংবিধানের সমালোচনা করে একে মূল্যহীন বলে প্রতিপন্ন করেন।

তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৭২ সালের সংবিধানকে একটি উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ দলিল বলে অভিহিত করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মতে, “খসড়া সংবিধান বিলটি অতিশয় ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ।” তারা বলেছেন, “সংবিধান বিলটি রচনা করা হয়েছে চারটি মৌল নীতির উপর ভিত্তি করে। যেমন- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়ভাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে।

চতুর্থত, খসড়া সংবিধানের প্রতি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) যথেষ্ট নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে, যেহেতু তাতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। তারা অভিযোগ করেন যে, খসড়া সংবিধান কোনো জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনমণ্ডলীর আস্থা হারালে সেক্ষেত্রে কী হবে তার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি।

পঞ্চমত, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন খসড়া সংবিধানটিকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে আখ্যা দেন। তবে যেহেতু তা সমাজতান্ত্রিক সংবিধান ছিল না, কাজেই যত দিন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হবে, তত দিন খসড়া সংবিধানটিকে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে গণ্য করা উচিত বলে তারা অভিমত পোষণ করেন।

ষষ্ঠত, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) খসড়া সংবিধানকে মোটামুটিভাবে গ্রহণ করে। তবে এ দল সংবিধানে কতিপয় সংশোধনী আনয়নের প্রস্তাব করে। দলের সাধারণ সম্পাদক এক প্রচারপত্র বিলির মাধ্যমে সর্বমোট ১১টি সংশোধনী প্রস্তাব আনয়ন করেন।

সপ্তমত, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (সিদ্দিকী গ্রুপ) খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করাকে অভিনন্দন জানান। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ খসড়া সংবিধানকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গণ্য করেন। তারা মনে করেন যে, সংবিধানটি কৃষক শ্রমিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি সুদৃঢ় পদক্ষেপ।

অষ্টমত, ১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈধতার ভিত্তি ছিল জনগণের সম্মতি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণ নিরঙ্কুশভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল একটি সুন্দর শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য। আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি জনগণের সম্মতি অটুট রেখেছিল।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। যেমন- এ সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার খুব সীমিত ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যবস্থা ছিল। কারণ সরকার জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে যে কোনো সময় মৌলিক অধিকার স্থগিত করতে পারতেন। যে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য যে জিনিসটি একান্ত প্রয়োজন তা হলো একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান যাবত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে।