উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে এক নির্মমতার সাক্ষর বহন করে। বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনতাকে এভাবে গণহত্যার নজির খুব কমই দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু অদম্য বাঙালিকে থামানো যায়নি। তারা এ গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং মুক্তির জন্য যুদ্ধ শুরু করে দেয়।
২৫ মার্চের গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম অবহেলা আর নির্যাতনে সাক্ষর বহন করছে, যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। ২৫ মার্চ এ অপারেশন সংঘটিত হলেও মূলত মার্চের প্রথম থেকেই এ গণহত্যার প্রস্তুতি চলতে থাকে। তবে এ প্রস্তুতিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রথম পর্যায়: ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ থেকে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা বৈঠক শুরু হয়। অন্যদিকে, ১৭ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন এবং রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায়: ১৯৭১ সালে ১৯ মার্চ থেকে পূর্ব বাংলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ শুরু হয়ে যায়। একই দিন জয়দেবপুরে বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। ২০ মার্চ সরকার অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি করে এবং জেনারেল হামিদ ক্যান্টনমেন্টগুলোতে খোঁজখবর রাখতে থাকেন। ঐদিনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। এ সময় প্রতিদিন ৬টি থেকে ১৭টি পর্যন্ত পি. আই. এ. ফ্লাইট বোয়িং ৭০৭বিমান সৈন্য ও রসদ নিয়ে ঢাকা আসত এবং অসংখ্য জাহাজ সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই হয়ে চাঁট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষা করে।
তৃতীয় পর্যায়: ২৪ মার্চ চট্টগ্রামে বন্দরে এম. ভি. সোয়াত থেকে অস্ত্র ও রসদ খালাস শুরু হয়। সব প্রস্তুতি শেষে ২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য বেছে নেওয়া হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে ঢাকা শহরের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়।
চতুর্থ পর্যায়: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট চালানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় রাত ১টা থেকে অপারেশন চালানো হবে। কিন্তু পথে বিলম্ব হবে ভেবে পাকিস্তানি সৈন্যরা ১১.৩০ এর সময় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এ সময় প্রথম আক্রমণের শিকার হয় ফার্মগেইট এলাকার রাস্তায় মিছিলরত মুক্তিকামী বাঙালিরা। একই সঙ্গে আক্রমণ চালানো হয় পিলখানাস্থ তৎকালীন ইপিআর হেডকোয়ার্টার ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। রাত ১.৩০ মিনিটের সময় বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আক্রমণ শুরু হয় গভীর রাতে। জহুরুল হক হল (তৎকালীন ইকবাল হল), জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলে চালায় হত্যা ও পাশবিক নির্যাতন। ২৫ মার্চ রাতে একইভাবে গণহত্যা চলেছিল পুরোনো ঢাকা, কচুক্ষেত, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে, ধানমণ্ডি, কলাবাগান, কাঁঠাল বাগান, গণকটুলি প্রভৃতি স্থানে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানো হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলেই শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তা ওয়্যারলেস যোগে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা শোনার পরই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। শুরু হয় পাকসেনাদের সঙ্গে বাঙালি পুলিশ, আনসার ও সাধারণ মানুষের এক অসম লড়াই ‘মুক্তিযুদ্ধ’।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয় ২৫ মার্চ থেকেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চরম নির্মমতা আর গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বীর বাঙালি। সবকিছুর স্বল্পতা সত্ত্বেও বাঙালি জাতি নিজেদের জাতীয়তাবোধ আর সমস্ত ধরনের নির্যাতন আর শোষণ বঞ্চনার জাল থেকে বেরিয়ে আসে এবং স্বাধীনতার লাল সূর্যটি ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়।