আল-কিন্দিকে কেন মুসলিম দর্শনের জনক বলা হয়?

অথবা, আল-কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলার কারণ ও তার যৌক্তিকতা নিরূপণ কর।

অথবা, আল-কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলার কারণ বিশ্লেষণ কর।

অথবা, কী কারণে আল-কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা হয় বিশ্লেষণ কর।

অথবা, যেসব কারণে আল কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা হয় তা বিস্তারিত আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম দর্শনে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ মিকদর্শনের বুদ্ধিবাদকে ব্যবহার করেছিলেন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যাবলি সমাধানে। অন্যদিকে, অন্য একটি দল একই প্রয়োগ পদ্ধতি আরও নিষ্ঠার সাথে ব্যবহার করেছিলেন শুধু ধর্মতাত্ত্বিক নয়, দর্শনের মৌলিক সমস্যার সমাধানে। মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে এ দলটি ‘ফালাসিফা’ নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মের আওতায় থেকে গ্রিক দর্শনের বুদ্ধিবাদী পদ্ধতিকে তারা দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করেছেন। এ চিন্তাধারার অগ্রনায়ক ছিলেন আল-কিন্দি। দর্শন ও বিজ্ঞান অধ্যায়নে আল-কিন্দি ছিলেন আরবীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে আরব দার্শনিক বলা হয়ে থাকে।

আল-কিন্দির পরিচয়: আল-ফিন্দির পুরো নাম ছিল আবু ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি। তিনি আরবের
আল-কিন্দি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামহ আল-আশাত ইবনে কায়েশ ছিলেন প্রাক ইসলামি যুগের ঐ বিখ্যাত আরবীয় গোত্রের বিশিষ্ট সদস্য। আল-কিন্দি গ্লিক ও সিরীয় ভাষায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তার সর্বমোট রচনা প্রায় ২৭০টি, যার অধিকাংশ রচনা আজ বিলুপ্ত প্রায়। তার জীবনীকারগণদের মতে, তিনি অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, সংগীত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং এমন আরও অনেক বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক এবং বিভিন্ন ভাষায় ও বিদ্যায় পারদর্শী মহাপণ্ডিত।

আল-কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলার কারণ ও যৌক্তিকতা: ইসলামে স্বাধীন চিন্তা নতুন কোন বিষয় নয়। ইসলাম কোন গোঁড়া ধর্মীয় মত নয়। বিচার ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসকে যাচাই ও বাছাই এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তোমরা আকাশ ও নক্ষত্ররাজির প্রতি দৃষ্টি দাও এবং এর অপর রহস্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা কর। শুধু তাই নয়, তোমরা কি আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কোন খুঁত দেখতে পাবে। ফলে দেখা যায় যে, কুরআন ও হাদিসে নির্দেশিত চিন্তার কথা বলা হয়েছে। মুসলমানগণ কুরআন ও হাদিসের এ আহবান দ্বারা প্রভাবিত হন এবং স্বাধীন চিন্তায় আত্মনিয়োগ করেন। আর এর ফলশ্রুতিতে আমরা প্রথমে কাদারিয়া, জাবারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব লক্ষ্য করি। এদের পথ ধরে আমরা পরবর্তীতে মুতাজিলা এবং আশারীয়দের চিন্তার বিকাশ লক্ষ্য করি। মুতাজিলারা প্রথম বুদ্ধিবাদী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। তারা গ্রিক বুদ্ধিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হন এবং গ্রিক বুদ্ধিবাদকে মুসলিম ধর্মতত্ত্বে প্রয়োগের চেষ্টা করেন। তারা প্রত্যাদেশকে বুদ্ধির মাধ্যমে ব্য মানব চিন্তার আকারের মাধ্যমে প্রতিপাদনের চেষ্টা করেন। এর দ্বারা তারা ইচ্ছার স্বাধীনতা, আল্লাহর গুণাবলি, কুরআনের নিত্যতা প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা। কিন্তু আল্লাহ এমন এক সত্তা, যা বুদ্ধির মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে জানা যায় না। তাছাড়া বুদ্ধিতে রয়েছে বিরোধ। আর এ বিরোধ আমাদের সিদ্ধান্তকে বিরোধপূর্ণ করে তোলে। যদি আমরা বুদ্ধির মাধ্যমে কোন কিছুকে প্রতিপাদন করতে চাই, অর্থাৎ বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় পরিশেষে তা বিরোধে পরিণত হয়। মুতাজিলাগণ এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং একগুয়েমি প্রচার এর প্রতি মানুষের বিরক্তি বাড়িয়ে দেয়। আর তাই মুতাজিলাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ উদ্ভব হয় আশারিয়া সম্প্রদায়ের। আশারীয়রা অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল। তারা বুদ্ধির ব্যবহার করেছেন। তবে বিরোধ দেখা দিলে বুদ্ধি থেকে সরে এসে প্রত্যাদেশের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত মুসলিম চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয় না, বরং ধর্মতত্ত্বকে প্রতিপাদনে স্বাধীন চিন্তার ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয়। মুতাজিলাদের বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব হতে মুসলিম চিন্তাবিদগণ কখনও সরে আসতে চান নি। এর ফলশ্রুতিতে ইসলামে বুদ্ধিবাদের নধ্য বিকাশ পরিলক্ষিত হয়, যা মুসলিম দর্শনে ফালাসিফা নামে পরিচিত। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন আল-কিম্পি। তিনিই প্রথম চিন্তাবিদ, যিনি প্রচলিত দর্শনের সমস্যাগুলোতে দার্শনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। অর্থাৎ, তিনি ধর্মতত্ত্বকে ছাড়িয়ে জগৎ ও জীবনে নানাবিধ প্রশ্নকে নানা দিক হতে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে আল-কিন্দির মধ্যে আশারীয়দের পরমাণুবাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি জগতের উৎপত্তি সম্পর্কিত তত্ত্ব আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রটিনাসের Theory of Emanation বা নির্গমন তত্তকে মুসলিম চিন্তাচেতনার আলোকে বা কুরআন ও হাদিসের আলোকে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সূর্য হতে যেমন তার আলোক রশ্মি বিচ্যুরিত হয়, তেমনি আল্লাহ হতে জগৎ এবং অপরাপর সৃষ্ট বস্তু নির্গমন হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। তাই সব কিছু যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে তখন তা আবার আল্লাহ’তে সমপতিত হবে। তার এ মত মুসলিম চিন্তাবিদদের চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলে। জগৎ সৃষ্টি সম্পর্কিত এমন ব্যাখ্যা আগে মুসলিম চিন্তাবিদগণ দেন নি। তিনিই প্রথম স্বাধীন চিন্তার আলোকে জগৎ ব্যাখ্যার প্রয়াশ চালান। মুতাজিলারা বুদ্ধির ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তারা তা শুধু ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাপারাদিতেই সীমাবদ্ধ রাখে। কিন্তু আল-কিন্দি ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাপারাদি ছাড়িয়ে জগৎ ও জীবনে মৌলিক সমস্যাবলিকে বুদ্ধির আলোকে বিচার করেছেন। আর তাই আল-কিন্দিকে মুসলিম দর্শনের জনক বলা চলে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পাশ্চাত্য দর্শনে থেলিস মুসলিম যেমন পৌরাণিক কাহিনীকে বাদ দিয়ে বিচার ও বৃদ্ধির মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যার জন্য পাশ্চাত্য দর্শনের জনক হিসেবে পরিচিত, ঠিক তেমনি আল-কিন্দি মুসলিম ধর্মতত্ত্বের ঊর্ধ্বে গিয়ে জগতের মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার মত কতটুকু গ্রহণযোগ্য এ বিষয়টি অবান্তর। তবে তার প্রয়াশ অবশ্যই প্রশংসনীয়। আর তাই তিনি মুসলিম দর্শনের জনক হিসেবে পরিচিত।