অথবা, মুসলিম দর্শনে আল-কিন্দিকে কোন কোন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়? তার দর্শন তত্ত্বের আলোকে আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শনে আল-কিন্দির গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শনে আল-কিন্দির গুরুত্ব বর্ণনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম দর্শনে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদগণ গ্রিকদর্শনের বুদ্ধিবাদকে ব্যবহার করেছিলেন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যাবলি সমাধানে। অন্যদিকে, অন্য একটি দল একই প্রয়োগ পদ্ধতি আরও নিষ্ঠার সাথে ব্যবহার করেছিলেন। শুধু ধর্মতাত্ত্বিক নয়, দর্শনের মৌলিক সমস্যার সমাধানে। মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে এ দলটি ‘ফালাসিফা’ নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মের আওতায় থেকে গ্রিক দর্শনের বুদ্ধিবাদী পদ্ধতিকে তারা দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করেছেন। এ চিন্তাধারার অগ্রনায়ক ছিলেন আল-কিন্দি। খ্রিস্টীয় নবম শতকে ইসলামে যে ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আন্দোলন রচিত হয়েছিল এর পিছনে কিন্দির সুস্পষ্ট অবদান ছিল। শুধু তাই নয়, সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিজাতীয় ধ্যানধারণা গ্রহণে যে বিতৃষ্ণা, অনাগ্রহ ও শৈথিল্য ছিল তা দূরীকরণেও তার ভূমিকা ছিল অনন্য।
আল-কিন্দির পরিচয়: আল-কিন্দির পুরো নাম ছিল আবু ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-তিন্দি। তিনি আরবের আল-কিন্দি গোত্রে জন্যগ্রহণ করেন। তার পিতামহ আল-আশাত ইবনে কায়েশ ছিলেন প্রাক ইসলামি যুগের ঐ নির্যাত আরবীয় গোত্রের বিশিষ্ট সদস্য। আল-কিন্দি গ্রিক ও সিরীয় ভাষায় যথেষ্ট পান্তিতা অর্জন করেন। তার সর্বমোট রচনা প্রায় ২৭০টি, যার অধিকাংশ রচনা আজ বিলুপ্ত প্রায়। তার জীবনীকারগণদের মতে, তিনি অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, সংগীত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং এমন আরও অনেক বিষয়ে মৌলিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক এবং বিভিন্ন ভাষায় ও বিদ্যায় পারদর্শী মহাপণ্ডিত।
মুসলিম দর্শনে আল-কিন্দির গুরুত্ব: মুসলিম চিন্তার ইতিহাসে ফালাসিফা চিস্তাগোষ্ঠীর প্রবর্তক এবং প্রথম আরব দার্শনিক হলেন আল-কিন্দি। তিনি ছিলেন সর্ববিজ্ঞান বিশারদ। তিনি তার সমসাময়িক যুগে ধাবতীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতি আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, তিনি তার অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন প্রাপ্ত হন নি। তিনি নব্য প্লেটোবাদী বীতিতে প্লেটো ও এরিস্টটলের মতবাদের সম্মিলন ঘটাতে চেয়েছেন এবং নব্য পিথাগোরীয়ান গণিতশাস্ত্রকে সকল বিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার চিন্তার মধ্যে যথেষ্ট মৌলিকত্ব রয়েছে। আর সে কারণে। মুসলিম দর্শনে তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচিত হলো:
১. প্রথম মুসলিম দার্শনিক: প্রথম মুসলিম দার্শনিক বলতে দর্শনের ইতিহাসে আল-কিন্দিকেই বুঝায়। তিনিই প্রথম দর্শনে ইসলামের মৌলিক বিষয়ের আলোচনা সম্ভব করেছিলেন। তার পূর্ববর্তী মুসলিম চিন্তাবিদগণ যা আলোচনা করেছে তাকে Acadamic philosophy বলা চলে না, বরং তো ছিল ধর্মতত্ত্বকে প্রত্যাদেশ অথবা বুদ্ধির মাধ্যমে বুঝার প্রচেষ্টা মাত্র। তাই প্রথম মুসলিম দার্শনিক হিসেবে আল-তিন্দির গুরুত্ব অপরিসীম।
২. ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয়: মুসলিম চিন্তাবিদগণ যেমন বুদ্ধির ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে আস্থাশীল ছিলেন, তেমনি প্রত্যাদেশকে তারা গুরুত্ব দেন। কিন্তু কেউ কেউ প্রত্যাদেশকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বুদ্ধির কার্যকারিতাকে অস্বীকার করেছেন। আবার কেউ কেউ বুদ্ধিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রত্যাদেশের গুরুত্বকে হালকা করে ফেলেছিলেন। মুতাজিলারা বুদ্ধি ও প্রত্যাদেশের সমন্বয় করলেও বুদ্ধিকে প্রাধাণ্য দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, আশারিয়রা বুদ্ধি ও প্রত্যাদেশের সমন্বয় করলেও প্রত্যাদেশকেই প্রাধান্য দেন। কিন্তু আল-কিন্দি প্রথম মুসলিম দার্শনিক, যিনি বুদ্ধি ও প্রত্যাদেশকে সমভাবে গুরুত্ব দেন। দর্শন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে নির্দেশ করে। অন্যদিকে, ধর্ম প্রত্যাদেশকে নির্দেশ করে। আল-কিন্দির লক্ষ্য ছিল এদের সমন্বয়কে সম্ভব করা এবং সে অনুসারে একটি সমন্বিত মত প্রতিষ্ঠা করা।
৩. দর্শন চর্চায় পথপ্রদর্শক: মুসলিম চিন্তাবিদগণ বিজাতীয় চিন্তাধারার প্রতি অনেকটা অনিচ্ছুক বা Relactant. আল-কিন্দি এ অবস্থায় পরিবর্তন ঘটান। তিনি গ্রিক দর্শনে সত্তা সম্পর্কিত প্লেটো ও এরিস্টটলের মত দ্বারা দারুণভাবে আলোড়িত হন। তার মতে, বুদ্ধির দ্বারা আমরা যদি আল্লাহর স্বরূপ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করি, তাহলে প্লেটো-এরিস্টটলের পদ্ধতি বা নব্য প্লেটোবাদী পদ্ধতি যথেষ্ট কার্যকরী, কিন্তু সেটি তিনি যান্ত্রিক অনুকরণের মাধ্যমে করেছেন তা বলা চলে না। কেননা আমরা দেখি যে, তিনি পরমসত্তা সম্পর্কে এমন ব্যাখ্যা দেন যা নব্য প্লেটোবাদে পরিলক্ষিত হয় না। তার এ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরবর্তী চিন্তাবিদগণ দারুণভাবে প্রভাবিত হন এবং তাকে অনুসরণের চেষ্টা করেন। এর ভিত্তিতে বলা চলে তিনি দর্শন চর্চার পথপ্রদর্শক।
৪. গণিত ও বিজ্ঞান চর্চার পথপ্রদর্শক: মুসলমানদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি ততটা আগ্রহ দেখা যায় না, সে তুলনায় ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তিনি প্লেটোর মত গণিতকে দর্শনালোচনার প্রারম্ভবলে অভিহিত করেন। ড. আহমদ ফুয়াদ আল-ইহওয়ানির মতে, তিনি হলেন সর্বপ্রথম দার্শনিক, যিনি মনে করেন যে, সত্যের অনুসন্ধানে গণিতশাস্ত্র হলো সর্বপ্রথম দার্শনিক অস্ত্র। তার মতে, তার এ ধারণা পরবর্তী দর্শন ও বিজ্ঞানের উপর গভীর প্রভাব রেখেছিল।
৫. তর্কশাস্ত্রে আল-কিন্দির অবদান: O. Leary তাঁর Arabic Thought and Its Place in History গ্রন্থে বলেছেন, একথা সত্য যে, মিক হতে সরাসরি অনুবাদের মাধ্যমে তিনি এরিস্টটলীয় পাণ্ডিত্যের দ্বারা উম্মোচন করেছিলেন, তবে তা এ যাবৎ অনুশীলনকৃত যাবতীয় বিষয়বস্তুর উপর অগ্রগামিতা সূচিত করেছিল। তাছাড়া এটা বলা চলে যে, মুসলিম দর্শনের চিন্তাধারায় আল-কিন্দি তর্কশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন বলেই আল-ফারাবির পক্ষে আল-মুয়াল্লিম-আল সানী হওয়া সম্ভবপর হয়েছিল।
৬. প্রথম আরব দার্শনিক হিসেবে গুরুত্ব: আল-কিন্দি প্রথম আরব দার্শনিক। আর এ হিসেবে তার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনিই প্রথম আরব চিন্তাবিদ, যিনি মনে করেন, ধর্মীয় বিষয়ে দর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তার পরবর্তী সময়ে যদিও অনেক আরব চিন্তাবিদের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু তিনিই প্রথম আরব দার্শনিক।
৭. ধর্মতত্ত্বের প্রভাব সীমিতকরণ: আল-কিন্দি প্রথম মুসলিম চিন্তাবিদ, যিনি মুসলিম চিন্তার ইতিহাসে সর্বপ্রথম ধর্মতত্ত্বের প্রভাবকে সীমিত করেন। একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, ধর্মতত্ত্বের যুক্তিলাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। পরবর্তীতে, ইমাম গাজালি এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছিলেন, ধর্মতাত্ত্বিকদের অবশ্যই যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন করতে হবে। এটি করতে হবে ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়গুলো আরও যুক্তিপূর্ণ ও সাদৃশ্যপূর্ণভাবে উপস্থাপন করার জন্য। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো আল-কিন্দি ধর্মতত্ত্বের তথা মুসলিম চিন্তাবিদগণকে ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান থাকলেই চলবে না তাকে যুক্তিপূর্ণভাবে কথা ও কাজ করতে হবে। এর অর্থ হলো চিন্তার ক্ষেত্রে ধর্মতত্ত্বের প্রভাব সীমিত করে যুক্তিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-কিন্দি প্রথম দার্শনিক, যিনি কুরআন ও হাদিসের আলোকে দার্শনিক আলোচনাকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন। তার যুক্তিবিজ্ঞান এবং গণিতের প্রতি গুরুত্ব প্রদান ধর্মতাত্ত্বিক তথা অপরাপর চিন্তাবিদদের নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করে নব্য প্লেটোবাদীদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত তবে কুরআনের ও হাদিসের আলোকে এর ব্যাখ্যাটি সত্যিই অভিনব। আর এদিক দিয়ে বিচার করলে (মুসলিম দর্শনে) আল-কিন্দির অবদান অনস্বীকার্য।