আল-ফারাবির অধিবিদ্যা সংক্ষেপে লিখ।

অথবা, আল-ফারাবির অধিবিদ্যা বলতে কী বুঝিয়েছেন?

অথবা, আল-ফারাবির অধিবিদ্যা সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লিখ।

অথবা, অধিবিদ্যা সম্পর্কে আল-ফারাবি কী মতবাদ দেন?

অথবা, আল-ফারাবির অধিবিদ্যা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: যে দর্শন মূলত কুরআন ও হাদিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদ ও চিন্তাধারার দ্বারা বিকশিত হয়ে পরবর্তীতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে বজায় রেখে গ্রিক দর্শনসহ অন্যান্য দর্শনের সাথে সামঞ্জসা বিধান করে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছে তাকে মুসলিম দর্শন বলে। মুসলিম দর্শনের চিজাধারা বিবর্তনের ক্ষেত্রে যে সম্প্রদায় অবর্ণনীয় অবদান রেখেছে তার নাম ফালাসিফা সম্প্রদায় বা দার্শনিক সম্প্রদায়। মুসলিম দার্শনিক ঐতিহ্যে অল-কিন্দি যে সুফিবাদী ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন তাকে আরও সুদৃঢ় ও সুসংবদ্ধ করেন আল-ফারাবি।

আল-ফারাবির অধিবিদ্যা: আল-ফারাবি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। আল-ফারাবি যুক্তিবিদ্যার ন্যাজ
অধিবিদ্যায়ও মৌলিক চিন্তাধারার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর অধিবিদ্যা বিষয়ক মতের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় Opinions of the Inhabitants of the Virtuous City’ (পবিত্র নগরীর অধিবাসীদের অভিমত) নামক গ্রন্থে। আল-ফারাবি তাঁর গ্রন্থটি শুরু করেছেন আদিসত্তা, তাঁর গুণাবলি এবং তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনার মধ্য দিয়ে। তিনি তাঁর অধিবিদ্যায় সত্তা, সত্তার বিভিন্ন স্তর, পরমসত্তা, জগৎ সৃষ্টি, আত্যা, বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়গুলোকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

সত্তার স্বরূপ: আল-ফারাবির মতে, বস্তুত যা কিছু অভিত্বশীল তা হয় সম্ভাব্য, না হয় অনিবার্য সত্তা হবে এবং এদের মধ্যে তৃতীয় কোন সত্তা নেই। অর্থাৎ আল-ফারাবির মতে, বস্তুজগৎ দু’ভাগে বিভক্ত। যথা:

১. সম্ভাব্য সত্তা (Contingent Being) এবং

২. অনিবার্য সত্তা (Necessary Being)

সম্ভাব্য সত্তা হলো এমন সত্তা যা অনিবার্যভাবে অস্তিত্বশীল নয়, কেবল সম্ভাব্যভাবে অস্তিত্বশীল। আল-ফারাবির মতে, যা কিছু সম্ভাব্য, তা তার বাস্তবায়নের জন্য একটা কারণকে পূর্ব থেকে ধরে নেয়। কেননা সম্ভাব্য সত্তার অস্তিত্ব কোন না কোন কারণের উপর নির্ভরশীল। কারণ ব্যতীত সম্ভাব্য সত্তা থাকতে পারে না। এ সত্তাকে যেহেতু অস্তিত্বশীল হওয়ার জন্য অন্য কোন শর্তের উপর নির্ভর করতে হয় সেহেতু এ সত্তাকে বলা হয় শর্তাধীন সত্তা। আল্লাহ ব্যতীত যাবতীয় বস্তুই সম্ভাব্য সত্তা। প্রত্যেক সম্ভাব্য সত্তা কোন না কোন কারণের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ প্রত্যেক সম্ভাব্য সত্তার একটি কারণ আছে, যে কারণটি আবার পূর্ববর্তী একটি কারণ থেকে উদ্ভূত। এভাবে প্রত্যেকটি সম্ভাব্য সত্তা এবং এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটি প্রথম বা আদি কারণকে স্বীকার করে নিতে হয়, যা স্বয়হু। অর্থাৎ যা অন্য কোন কারণের কার্য নয়। আল-ফারাবি এই প্রথম বা আদি কারণকে বলেছেন আবশ্যিক বা অনিবার্য সত্তা, যা এক ও অদ্বিতীয়, চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় এবং যা নিঃশর্ত ও অনিবার্যভাবে বিদ্যমান। আল-ফারাবির মতে, এ আদি কারণই বিশ্বজগতের স্রষ্টা অর্থাৎ আল্লাহ। এ সত্তার অস্তি ত্ব প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। কারণ তা নিজেই নিজের অস্তিত্বের ভিত্তি ও বড় প্রমাণ।

সত্তার গুণাবলি: আদিসত্তা বা পরমসত্তা সবধরনের সত্তা, সত্য ও কারণের মূল উৎস। বিশ্বজগতের সবকিছুর অস্তিত্ব ও সত্যতা তাঁর উপর নির্ভরশীল। তাঁর সাথে কোনকিছুর সাদৃশ্য নেই এবং তাঁর সাথে জাগতিক সত্তার তুলনা করা যায় না। পরমসত্তা শাশ্বত, অতুলনীয়, অপরিবর্তনীয়, একক ও অদ্বিতীয়; তাঁর সারসত্তা ও অস্তিত্ব এক ও অভিন্ন। পরমসত্তার এসব গুণ তাঁর অন্তঃসারের অতিরিক্ত স্বতন্ত্র কোনকিছু নয়, এরই অংশবিশেষ।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবি ছিলেন একজন সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক। তাঁর মতের সাথে আধুনিক ও সাম্প্রতিককালের অনেক চিন্তাচেতনার অবভাস মেলে। তাঁর মতের প্রভাব পরবর্তী দার্শনিকদের উপর পড়েছে। তিনি পরমসত্তাকে বলেছেন এক এবং বহুত্ব হচ্ছে আবশ্যিক সত্তা। সুতরাং আল-ফারাবির অধিবিদ্যার গুরুত্ব অপরিসীম।