অথবা, মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবি কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে?
অথবা, মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবির প্রভাব কী?
অথবা, মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবির প্রভাব কিরূপ?
অথবা, মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবির প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা: মুসলিম দার্শনিক ঐতিহ্যে আল-কিন্দি যে সুফিবাদী ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন তাকে আরও সুদৃঢ় ও সুসংবদ্ধ করেন পরবর্তী দার্শনিক আল-ফারাবি। এরিস্টটলের যুক্তিবিজ্ঞানের প্রখ্যাত ব্যাখ্যা দাতা হওয়ার কারণে আঁকে মুয়াল্লিম আল-সানি (দ্বিতীয় শিক্ষক) অর্থাৎ দ্বিতীয় এরিস্টটল বলে আখ্যায়িত করা হয়। ফারাবিব দর্শনের প্রভাব শুধু পাশ্চাতোই সীমাবদ্ধ থাকে নি, বরং এ উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশেও পড়েছে।
মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবির প্রভাব: আল-ফারাবি জানানুশীলনের অনিবার্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন স্থান পর্যটন করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। তিনি বহু গ্রন্থের অনুবাদক ও ভাষ্যকার এবং অনেক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি মিক দর্শনের জটিল সমস্যাবলি সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন ও প্রকাশের ব্যাপারে অদ্বিতীয়। প্রাচ্যে ইখওয়ান আল-সাফা, ইবনে সিনা, ইবনে মিশকাওয়াহ, ইবনে খালদুল শেখ মুহাম্মদ আবদুহু, জামালউদ্দিন আফগানী প্রমুখ দার্শনিকেরা আল-ফারাবির দর্শনের অনুরাগী ছিলেন। খোদান নস্তিত্ব, একত্ব, পৃথিবীর নিত্যতা, সত্তা, দ্রব্য প্রভৃতি বিষয়ে আল-ফারাবির ধারণা দ্বারা ইবনে রুশদ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আল-ফারাবির রাষ্ট্রদর্শন দ্বারা ইবনে রুশদ প্রভাবিত হয়ে প্লেটোর রিপাবলিক এর ভাষ্য রচনা করেছিলেন। আল-ফারাবির দর্শন সম্পর্কে ইকবাল বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁর পিএইচডি থিসিস ‘দি ডেভেলপমেন্ট অফ মেটাফিজিকস ইন পারসিয়া’ গ্রন্থে ফারাবির দর্শনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
আল-ফারাবি কিভাবে এরিস্টটলের মনোবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন এবং পরবর্তীকালে কিভাবে এর উন্নতি সাধিত হয় ল্যাটিন ভাষাভাষী বিজ্ঞজনের কাছে তা কিভাবে সম্প্রচারিত ও সম্প্রসারিত হয় এসব বিষয়ে ই. জি, গিলসন (E. G. Gilson) অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
আল-ফারাবি খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বতাত্ত্বিক প্রমাণের সূত্রপাত করেন। পরবর্তীকালে ইহুদি দার্শনিক মাইমুনীডস খ্রিস্টান চিন্তাবিদ থমাস একুইনাস, আধুনিক যুগের দার্শনিক ও লাইবনিজ ও স্পিনোজ এ প্রমাণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আল-ফারাবি খোদার অস্তিত্বের প্রমাণ করতে গিয়ে যেসব যুক্তি দিয়েছেন রবার্ট হামুন্ড সেসব যুক্তিকে সেন্ট থমাস একুইনাসের সাথে তুলনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, উক্ত বিষয়ে থমাস একুইনাস আল-ফারাবির দর্শন দ্বারা পুরোপুরিভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
মুসলিম দর্শনের চর্চা ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের স্বাধীন চিন্তাধারা বিনির্মাণে বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের বিকাশে সহায়তা করেছিল। তিনি যুক্তিবিদ্যার উপর অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। যুক্তিবিদ্যায় তাঁর অবদান সংক্রান্ত গবেষণা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে। ১৯৪৫ সালে খলিল গেওর (Khalil Geort) আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যার উপর পি-এইচ, ডি থিসিস রচনা করেছেন।
ক্যারো ডে ভক্স এর (Caro de Vaux) মতে, “ফারাবির ভাববাদী যুক্তিবিদ্যা ল্যাটিন চিন্তাবিদদের উপর প্রভাব বিস্তার
করেছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবি দর্শনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁর দর্শনের প্রভাব যেমন ছিল মধ্যযুগে, তার চেয়ে ব্যাপকতর হয়েছে বর্তমান ও সাম্প্রতিককালে। তাঁর দর্শন সার্বিক সত্যের সন্ধান দেয়। ম্যাকডোনাল্ড যথার্থই মন্তব্য করেছেন, আল-ফারাবি ছিলেন মুসলিম দর্শনের পিরামিডের মূলভিত্তি। ফলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশে এবং প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে কমবেশি আল-ফারাবির দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।