অথবা, আল-ফারাবি কে ছিলেন? তাঁর অধিবিদ্যা সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, আল-ফারাবিকে কেন দ্বিতীয় শিক্ষক বা ‘মুয়াল্লিম সানী’ বলা হয়?
অথবা, আল-ফারাবিকে দ্বিতীয় শিক্ষক বলার কারণ কী? তাঁর অধিবিদ্যা বর্ণনা কর।
অথবা, আল-ফারাবিকে দ্বিতীয় শিক্ষক বলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং তাঁর অধিবিদ্যা সম্পর্কে বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: ভূমিকা: ফালাসিফা সম্প্রদায়ের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ছিলেন আল-ফারাবি। তাঁর পূর্ণ নাম আবু নছর মুহম্মদ আল-ফারাবি। তিনি ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফারাব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি পরবর্তী মুসলিম দার্শনিকদের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। ম্যাকাডোনাল্ড বলেছেন, “আল-ফারাবি ছিলেন মুসলিম দর্শন পিরামিডের ভিত্তি স্বরূপ”। ইবনে খাল্লিকানের মতে, “কোন মুসলিম চিন্তাবিদই জ্ঞানের ক্ষেত্রে আল-ফারাবির ন্যায় অনুরূপ দার্শনিক মর্যাদায় উন্নীত হতে পারেন নি।” তিনি প্রায় সত্তরটি ভাষা জানতেন।
আল-ফারাবিকে দ্বিতীয় শিক্ষক বলার করণ: এরিস্টটল হলেন মুসলিম দর্শন বিকাশের প্রথম শিক্ষক। তিনিই সর্বপ্রথম ধর্মতত্ত্বকে খাঁটি দর্শন বলে আখ্যা দেন এবং সমগ্র ইউরোপ তথা বিশ্বে তাঁর দার্শনিক তত্ত্ব প্রচার করেন। এরিস্টটলের ভাবগম্ভীর দর্শন ও বস্তুবাদী জ্ঞানের দ্বারা ইউরোপে পুনর্জাগরণ তথা আধুনিক বিজ্ঞানের যুগের আবির্ভাব ঘটে। আল-ফারাবি তাঁর তরুণ বয়সে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থে যুক্তিবিদ্যা নব্য পিথাগোরীয় তত্ত্ব এবং প্রাকৃতিক দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। তিনি এরিস্টটলের গ্রন্থ ও দর্শন অধ্যয়ন করে তা দ্বারা এত বেশি প্রভাবিত হয়েছেন যে, তাকে দ্বিতীয় এরিস্টটল বা শিক্ষক বলা হয়।
এরিস্টটলের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল যুক্তিবিদ্যা প্রতিষ্ঠা। ফারাবি এরিস্টটলের মত যুক্তিবিদ্যাকে আনস অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ বাহন মনে করেন এবং যুক্তিবিদ্যা দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। তারা উভয়েই যুক্তিবিদ্যাকে জ্ঞানের যে কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপায় মনে করেন। এরিস্টটলের মত ফারাবিও কারণের কারণ খুঁজতে গিয়ে আদি সনায় উপনীত হন। ফারাবির দৃষ্টিতে সে আদি সত্তা হলেন আল্লাহ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফারাবির যুক্তিবিদ্যায় এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার প্রভাব রয়েছে। শুধু যুক্তিবিদ্যা নয় অনেক ক্ষেত্রেই এরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দর্শনের ক্ষেত্রেও তিনি এরিস্টটলের ধর্মতত্ত্বকে একটি খাঁটি দর্শন বলে গ্রহণ করেন। উপরিউক্তভাবে এরিস্টটলের দর্শনে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ও সূক্ষ্মদর্শিতা তাকে তার সমালোচক, ভাষ্যকার ও অনুসারীদের মধ্যে শীর্ষ আসন দান করেছে। এ সকল কারণেই আল-ফারাবিকে দ্বিতীয় শিক্ষক বলা হয়।
আল-ফারাবির অধিবিদ্যা: আল-ফারাবি অধিবিদ্যা ব্যাখ্যায় মৌলিক চিন্তাধারার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর মতে, সত্তা দু’ধরনের-সম্ভাব্য ও অনিবার্য। প্রত্যেক সম্ভাব্য সত্তার একটি কারণ রয়েছে। যে কারণ থেকে ঐ সত্তার উদ্ভব। এ কারণটি সম্ভাব্য সত্তা এবং এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত এমন একটি আদিকারণে উপনীত হই, যার পেছনে আর কোন কারণ থাকে না।
আমরা এখানে এমন একটি সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হই, যা স্বকারণিক। এটি একটি একক স্বয়ংগঠিত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা এবং অপরিবর্তনীয় ও সর্বোচ্চ পূর্ণতার অধিকারী। তাঁর মতে, এ সত্তা এক ও অদ্বিতীয়। এটি একাধারে বাহ্য ও আন্তরব্যাপী ও অতিবর্তী। এ পরমসত্তার অস্তিত্ব প্রমাণসাপেক্ষ নয়। কারণ তা নিজেই তার অস্তিত্বের ভিত্তি ও বড় প্রমাণ।
আল-ফারাবির মতে, সকল বিজ্ঞানের আদি বিজ্ঞান হল দর্শন। মানবজীবনের পরম লক্ষ্য থাকে দার্শনিক জ্ঞানলাভকরা। দর্শন একমাত্র শাস্ত্র যা জগতের অনন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে অখণ্ড ঐক্যসূত্র স্থাপন করতে পারে। আল-ফারাবি স্যাকে সম্ভাব্য ও নিশ্চায়াত্মক এ দু’ভাগে ভাগ করেছেন। প্রত্যেকটি সম্ভাব্য মূলে একটা কারণ আছে, যা থেকে এর উৎপত্তি হয়। এ কারণটি নিজেই আবার পূর্ববর্তী কারণের ফল। এভাবে সত্তা ও তাঁর অনুসন্ধান করতে করতে এমন এক আদি কারণে উপনীত হই যার কোন কারণ নেই।
আদি কারণ ও পরমসত্তাকে আমরা আল্লাহ বলি। এ আদি সত্তার কোন সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। ফারাবির মতে, মানুষ মাত্রই সীমিত জ্ঞানের অধিকারী। এ সীমিত জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। তবে তিনি অজ্ঞেয় হলেও অনিবার্য ও জগতের সবকিছুর মধ্যে বিরাজমান।
কাজেই জাগতিক বস্তু ও ঘটনাবলি থেকে আল্লাহকে জানা সম্ভব। এককথায়, আল্লাহকে সরাসরি জানা না গেলেও জীব ও জগতের জ্ঞানের মধ্য দিয়ে তাকে জানা যায়। এভাবে ফারাবি আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের ব্যাপারে এক সর্বেশ্বরবাদী ধারণায় উপনীত হন।
ফারাবি উচ্চতম থেকে নিম্নতম সত্তার বিভিন্ন স্তরের ক্রমিক বর্ণনা দেন। তাঁর মতে, আল্লাহ আদি সত্তা এবং তিনি অনাদি, অনন্তকাল থেকে অস্তিত্বশীল। সবরকমের জিনিসের আকার আগে থেকে আল্লাহর ছিল। দ্বিতীয় সত্তা হল আল্লাহর প্রকৃতি এবং এটি প্রথম সৃষ্ট চিদাত্মা।
প্রথম সৃষ্ট চিদাত্মা থেকেই পরপর সৃষ্টি হয়েছে নভোমণ্ডলের আটটি চিদাত্মা। এ আটটি চিদাত্মা থেকে সৃষ্ট হয়েছে সৌরজগতের জ্যোতিষ্ক। সর্বমোট নয়টি চিদাত্মাকে বলা হয় স্বর্গীয় দূত এবং এদের সমন্বয়ে সত্তার দ্বিতীয় স্তর গঠিত হয়েছে।
সত্তার তৃতীয় স্তরে রয়েছে প্রজ্ঞা, চতুর্থ স্তরে রয়েছে আত্মা, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্তরে রয়েছে আকার ও জড়। জগতের সৃষ্টি একটি অনন্ত বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া। আল্লাহ নিজের সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে সৃষ্টি করলেন প্রথম চিদাত্মা। এরপর প্রথম চিদাত্মা তার নিজের সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে সৃষ্টি করলেন দ্বিতীয় চিদাত্মা। দ্বিতীয় চিদাত্মা তার নিজের এবং স্রষ্টার কথা ভাবতে গিয়ে সৃষ্টি করলেন প্রথম দেহ।
এভাবে প্রক্রিয়াটি উচ্চতম পর্যায় থেকে নিম্নতম পর্যায় পর্যন্ত চালিত’ হয়। এসব পর্যায় মিলে গঠন করে এক নিরবচ্ছিন্ন শৃঙ্খলা ও ঐক্য। আর জগতের সৃষ্টি ও সংরক্ষণ এ প্রক্রিয়ার ফল।
আল-ফারাবির মতে, সর্বনিম্নে অবস্থিত আদি জড় এবং এর উপরে রয়েছে চারটি উপকরণ। এ চারটি আদি উপকরণ হচ্ছে ক্রমানুযায়ী খনিজ দ্রব্য, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষ। পার্থিব জগতের সৃষ্ট বস্তুর সর্বশীর্ষে অবস্থিত মানবজাতির মধ্য দিয়ে এভাবে ক্রমোর্ধগামী সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় পরিসমাপ্তি ঘটে।
উপসংহার: পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, আল-ফারাবির অধিবিদ্যা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার এবং তিনি বুদ্ধির বিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। আল-ফারাবির যাবতীয় দার্শনিক তত্ত্বসমূহের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা। মুসলিম দর্শনে তাঁর অধিবিদ্যা তত্ত্বটি গুরুত্বের দাবিদার।