অথবা, জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে আল-ফারাবির মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আল-ফারাবির জ্ঞানতত্ত্ব বর্ণনা কর।
অথবা, আল-ফারাবির আনতত্ত্ব সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লেখ। ।
অথবা, আল-ফারাবির জ্ঞানতত্ত্ব বিশ্লেষণ কর
উত্তরঃ ভূমিকা: আনতত্ত্ব আল-ফারাবির দর্শনের একটি বিশেষ দিক। তাঁর দর্শনের মূল লক্ষ্য হল ইসলামি শিক্ষাকে প্লেটো ও এরিস্টটলের দর্শনের সাথে সমন্বয় সাধন করা। বর্তমান যুগের বিকশিত জ্ঞান প্রাচীন যুগে হয়েছিল অঙ্কুরিত, মধ্যযুগে প্রস্ফুটিত, জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার জন্য গড়ে উঠেছিল বায়তুল হেকমাহ। মুসলিম দার্শনিক আল-ফারাবি আনতত্ত্বের তাৎপর্য সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল ছিলেন। যতদূর জানা যায়, ইসলামের আগমনের পূর্বে ও আদি যুগে অনেক নবী ও রাসূল যেমন- হযরত ইব্রহীম (আ.), ইদ্রিস (আ.) এবং প্রাচীন যুগে গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
আল-ফারাবির জ্ঞানতত্ত্ব: মুসলিম দার্শনিক ঐতিহ্যে আল-কিন্দি যে সুফিবাদী ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন তাকে ফারাবি আরও সুদৃঢ় ও সুসংবদ্ধ করেন। তিনি জ্ঞানানুশীলনের অনিবার্য প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন স্থান পর্যটন করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। তিনি প্রথমেই তাঁর শৈশবের আবাস দামেস্ক ছেড়ে বাগদাদ যান এবং আবু বিসর মাত্তা ইবনে ইউনুস ও ইউহান্না প্রমুখ শিক্ষকের সংস্পর্শে আসেন। বিশ বছর বাগদাদে অবস্থানের পর তিনি আকৃষ্ট হন সেদিনের জ্ঞানবিজ্ঞানের বিশিষ্ট কেন্দ্র উত্তর সিরিয়ার এলোপ্পোর প্রতি।
আল-ফারাবি জ্ঞানের উৎস হিসেবে বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, স্বজ্ঞা ও ঐশি অনুপ্রেরণাকে স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি এসবের মধ্যে বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বুদ্ধিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা:
ক.ব্যবহারিক বুদ্ধি এবং খ. তাত্ত্বিক বুদ্ধি।
ক. ব্যবহারিক বুদ্ধি: আমাদের বাস্তব জীবনে কি করা উচিত বা অনুচিত ব্যবহারিক বুদ্ধি তা নিয়ে আলোচনা করে।
খ. তাত্ত্বিক বুদ্ধি: আত্মার উন্নতি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য সহায়তা করাই তাত্ত্বিক আলোচনার উদ্দেশ্য। তাত্ত্বিক বুদ্ধি তিন প্রকার। যথা।
১. সুপ্ত বুদ্ধি,
২. সক্রিয় বুদ্ধি এবং
৩. অর্জিত বুদ্ধি।
চালক নামে আর একপ্রকার বুদ্ধি আছে। এ চার প্রকার বুদ্ধির সমন্বয়ে এক উর্ধ্বগামী অনুক্রম গঠিত। নিম্নে এ চার প্রকার বুদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সুপ্ত বুদ্ধি: এটি আত্মার এমন এক ধরনের শক্তি, যার সাহায্যে জড়বস্তুর আপতিক গুণ থেকে প্রকৃত সত্তাকে মানসিকভাবে পৃথক করা সম্ভব হয়। ফারাবি মোমের প্রকৃতির সাথে সুপ্ত বুদ্ধির প্রকৃতির তুলনা করেছেন। কোন বস্তুর আকৃতির গলিত মোমের উপর যেভাবে দেওয়া যায় ঠিক সেভাবেই বস্তুর র আকৃতি আকৃতি খচিত খচিত হয়। এভাবে মোমের হাতি, মোমের ঘোড়া, মোমের পুতুল তৈরি করা সম্ভব। জড়বস্তুর ধারণা বা প্রত্যয় সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কিন্তু সে প্রত্যয়কে যখন জড়বস্তু থেকে পৃথক করা হয় তখন প্রত্যয়গুলো যথার্থভাবে মানুষের মনের মধ্যে স্থান লাভ করে গ্রথিত হয়।
২. সক্রিয় বুদ্ধি: সক্রিয় বুদ্ধি মনের ঊর্ধ্বগামী অনুক্রমের একটি বিশেষ স্তর। ইন্দ্রিয়জাত বস্তুর মধ্যে প্রত্যয়গুলো সুপ্তভাবে বিদ্যমান। প্রত্যয়গুলোকে জড়বস্তু থেকে যখন পৃথক করা হয়, তখন প্রত্যয়গুলো সক্রিয় প্রত্যয়ে পরিবর্তিত ও উন্নীত হয়। প্রত্যক্ষিত ধারণাগুলোর ব্যাপারে মানুষের মন শুধু সক্রিয় আর অপ্রত্যক্ষিত ধারণার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়। যখন মানুষের মন সক্রিয় বুদ্ধির স্তরে উন্নীত হয়, তখন সে নিজেকে চিনতে পারে এবং নিজের সম্পর্কে জ্ঞান লাভে সক্ষম হয়। এ আত্মজ্ঞানের সাথে বহির্বিশ্বের আনের কোন সম্পর্ক ও প্রভাব নেই। পুরোপুরিভাবে এটি অন্তঃপ্রত্যক্ষণ।
৩. অর্জিত বুদ্ধি: আল-ফারাবি সক্রিয় বুদ্ধির পর অর্জিত বুদ্ধি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মানুষ যখন বস্তুজগৎ থেকে প্রত্যয়ের পৃথকীকরণের মাধ্যমে বিমূর্ত ভাবধারা বুঝতে গত হয়, তখন সে বুদ্ধি এমন এক উচ্চতর স্তরে উন্নীত হয় যেখানে সে জাগতিক উপাদানের সহায়তা ছাড়াই বিক ভাবধারা বা বিশুদ্ধ প্রত্যয় ও ধারণাকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। বুদ্ধির এ স্তরকে অর্জিত বুদ্ধি বলা হয়ে থাকে। অর্জিত বুদ্ধি এক ধরনের অনুপ্রেরণা, স্বজ্ঞা ও উচ্চস্তরের মহৎ জ্ঞান। যদি বুদ্ধির এ স্তর উন্নত হয়, তাহলে মানুষ বিশ্ব সৃষ্টির অনেক রহস্য জানতে পারে এবং শুদ্ধ বৃদ্ধির জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়। এ স্তরে উন্নীত মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
মানুষ বুদ্ধির ক্রম অনুসারে সুপ্ত বুদ্ধিকে সক্রিয় বুদ্ধিতে এবং সক্রিয় বুদ্ধি থেকে অর্জিত বৃদ্ধির স্তরে উন্নীত হতে সক্ষম। বুদ্ধির নিম্নস্তর যদিও উচ্চস্তরে উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে কাজ করে তবুও বুদ্ধির বিভিন্ন স্তরের মধ্যে গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান। সুপ্ত বুদ্ধি গ্রহণ করে বাহ্যিক সংবেদনকে, সক্রিয় বুদ্ধি সংরক্ষণ করে ধারণাকে এবং প্রত্যয়কে বুঝানোর চেষ্টায় সহায়তা করে, অর্জিত বুদ্ধি তন্ময়তা, আধ্যাত্মিক মিলন ও খোদার তরফ থেকে অনুপ্রেরণা লাভের ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে।
৪. চালক বুদ্ধি: আল-ফারাবির ধারণা, নির্গমনের সূত্র ধরে আল্লাহর ইচ্ছায় এ বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অনুক্রমে দশটি স্তর হয়েছে। চালক বুদ্ধি হচ্ছে এ অনুক্রমের দশম স্তর। চালক বুদ্ধি মানুষের অন্তর্নিহিত সহজাত শক্তি নয়। মানুষের বাইরে এর অবস্থান। মানুষের সুপ্ত বৃদ্ধিকে চালক বুদ্ধি জাগ্রত করে এবং তাকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সজীব করে তোলে। চালক বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ আত্মা ও বুদ্ধির ক্রমবিবর্তনের ধারায় পূর্ণতা অর্জন করে। তাই চালক বুদ্ধির কাজ হলো মানুষের সাধারণ বুদ্ধিকে সুপ্ত স্তর থেকে সক্রিয় স্তরে উন্নীত করা।
মূল্যায়ন: আল-ফারাবির জ্ঞানতত্ত্বের মৌলিকত্ব সম্পর্কে অনেকে মন্তব্য করেছেন। ইব্রাহীম মায়কুর আল-ফারাবির জ্ঞানতত্ত্বের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, ফারাবির জ্ঞানতত্ত্বে এরিস্টটলের যেমন প্রভাব আছে তেমনি তাঁর মৌলিক অবদানও রয়েছে। তবে আল-ফারাবি তাঁর জ্ঞানতত্ত্বে অর্জিত বুদ্ধি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। নৈতিক দর্শনে চালক বুদ্ধির প্রয়োগের প্রয়াস আল-ফারাবির নিজস্ব অবদান।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবির জ্ঞানতত্ত্ব বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। তাঁর জ্ঞানতত্ত্বেও মনোবিদ্যার সাথে বিশ্বতত্ত্বের ধারণারও একটি সংমিশ্রণ রয়েছে। জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে এখানে মানুষের ভূমিকা অপেক্ষা আধ্যত্মিক শক্তির প্রাধান্য রয়েছে, যা এরিস্টটলের দর্শনে নেই। তাই মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবির জ্ঞানতত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।