আল-ফারাবির দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদ আলোচনা কর।

অথবা, দশম বুদ্ধি সম্পর্কে আল-ফারাবির মতামত যাচাই কর।

অথবা, আল-ফারাবির দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদ সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লেখ।

অথবা, আল-ফারাবির দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদ বিশ্লেষণ কর।

অথবা, আল-ফারাবির দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ভূমিকা: মুসলিম দর্শনের চিন্তাধারার বিবর্তনের ক্ষেত্রে যে সম্প্রদায় অবর্ণনীয় অবদান রেখেছে তার নাম। ফালাসিফা সম্প্রদায় বা দার্শনিক সম্প্রদায়। এ দার্শনিক চিন্তাধারার শুরু হয়েছিল মূলত আরবীয় দার্শনিক আল-কিন্দি থেকে এবং তার পর যারা মুসলিম দার্শনিক হিসেবে বিশেষভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবু নসর আল-ফারাবি (২৫৮ হি./৮৭০ খ্রি. ৩৩৯হি./৯৫০খ্রি.)। কেউ কেউ মনে করেন, যেসব দার্শনিক গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত তাদের মধ্যে ফারাবি সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি দর্শনের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদ।

দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদ (Ten Intelligence Theory): আল-ফারাবির দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদ ইসলামি দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এটি পদার্থবিদ্যা (Physics) ও জ্যোতির্বিদ্যার (Astronomy) মূলভিত্তি। এটি দু’টি জগৎ তথা স্বর্গ (Heaven) ও মর্ত্যের (Earth) ব্যাখ্যা এবং গতি (Motion) ও পরিবর্তন (Change) বিষয়ক ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করে। এর প্রধান বিষয় হল এক ও বহুর সমস্যা সমাধান এবং পরিবর্তনীয় ও অপরিবর্তনীয়ের তুলনা। আল-ফারাবি আল্লাহ্ সম্পর্কে এ মত পোষণ করেন যে, “God is necessary by Himself hence. He is not in need of another for His existence or His subsistence.” অর্থাৎ, তিনি বলেন, আল্লাহ স্বয়ং অনিবার্য সত্তা এবং সে কারণে তাঁর অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতার জন্য অপর কোনকিছুর উপর নির্ভর করার প্রয়োজন পড়ে না।

বিকিরণবাদের সাহায্যে দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদের ব্যবস্থা: আল-ফারাবির স্বর্গ ও মর্ত্যের ব্যাখ্যা এবং গতি ও পরিবর্তন বিষয়ক ঘটনার ব্যাখ্যা স্বীকার করলে একটি প্রশ্নের উদ্ভব হয়। আল্লাহ একত্বের আর জগৎ বহুত্বের প্রতীক। কিন্তু এ দু’য়ের মধ্যে কিভাবে সম্পর্ক স্থাপিত হয়? আল-ফারাবি এসব সমস্যার ব্যাখ্যা এক ধরনের বিকিরণ বা উন্মেষ এর মাধ্যমে করার
প্রয়াস পান। তিনি পরমসত্তা আল্লাহ থেকে বিভিন্ন বস্তুর বিকিরণের যে বিস্তৃত বিবরণ দেন তা আমাদেরকে বিশেষত নব্য প্রেটোবাদী দার্শনিক প্রেক্লাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি মনে করেন, আল্লাহ সরাসরি সৃষ্ট নয়, বরং কিছু মধ্যবর্তী শক্তির মাধ্যমে বিকীর্ণ। আল্লাহ্ তাঁর সত্তা অপরিমেয়তা ও পূর্ণতার কল্যাণে যে সত্তারাজি সৃষ্টি করেন সেগুলোর সবই এপ্রকৃতির অনিবার্যতার ফল। এমন ফল যা সম্পূর্ণরূপে তাঁর নির্বাচন ও ইচ্ছামুক্ত। জগৎ পরমসত্তার পূর্ণতায় নতুন কিছুই সংযোজন করে বা এবং তাকে উদ্দেশ্যবানী দিক থেকে নিয়ন্ত্রণও করে না। মূলত জগৎ প্রক্রিয়া স্রষ্টার এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত কর্ম বিশেষ।

দশটি বুদ্ধির উৎপত্তি: আল-ফারাবির মতে, অনিবার্য এক থেকে তার আত্মজ্ঞান ও সততার বলে আর একটি একের উন্মেষ হয়। তাঁর মতে, অনিবার্য এক বা পরম আদিসত্তা হল আল্লাহ্। এ পরম আনিসত্তা বা আল্লাহ থেকে উন্মেষিত হল প্রথম বা আদি বুদ্ধি। এ উনোষিত এক হল প্রথম বা আদি বুদ্ধি। এ আদি বুদ্ধি এক ও নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে। আনি বুদ্ধি যখন এক সম্পর্কে চিন্তা করে তখন দ্বিতীয় বৃদ্ধি (Second intelligence) এর উৎপত্তি হয়। আর আদি প্রথম বুদ্ধি (First intelligence) যখন নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে তখন First heaven এর সৃষ্টি হয়। আবার Second inteligence যখন প্রথম বুদ্ধি (First intelligence) সম্পর্কে চিন্তা করে তখন তৃতীয় বুদ্ধি (Third intelligence) অস্তি যে আসে। আর দ্বিতীয় বুদ্ধি (Second intelligence) যখন নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে তখন Second heaven এর উৎপত্তি হয়। Second heaven হচ্ছে Sphere of the sixed stars. এভাবে এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং একের পর এক আদি বুদ্ধি থেকে দ্বিতীয় বুদ্ধি, দ্বিতীয় বুদ্ধি থেকে তৃতীয় বুদ্ধি, তৃতীয় বুদ্ধি থেকে চতুর্থ বুদ্ধি এভাবে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম বুদ্ধির উন্মেষের কথা বলে নভোমণ্ডলসহ ভূমণ্ডলের সৃষ্টির কথা বলে। আল-ফারাবি দশম বা শেষ বুদ্ধিকে (Last intelligence) বলেছেন চালক বৃদ্ধি (Agent intelligence) যা পার্থিব জগৎ অর্থাৎ ভূমণ্ডলকে নিষয়। করে।

জ্যোতির্বিদ্যার সাহায্যে দশম বুদ্ধি মতবাদের ব্যাখ্যা: বুদ্ধির সংখ্যা হল দশটি। এ বুদ্ধি গঠিত হয় আদি বুদ্ধি এবং গ্রহ (Planets) ও গোলক (Spheres) নয়টি বুদ্ধির সমন্বয়ে। আল-ফারাবি গ্রিক জ্যোতির্বিদদের বিশেষ করে টলেমির মতবাদকে গ্রহণ করেন। টলেমির মতে, বিশ্বজগৎ নয়টি বৃত্তাবদ্ধ গোলকের দ্বারা গঠিত, যার সবগুলোই পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে। বুদ্ধি ও আত্মা হল এ গতির চালক। প্রত্যেক Spheres (গোলক) এর নিজস্ব বুদ্ধি ও আত্মা রয়েছে। ফারাবির মতে, ঘটনার নিয়ন্ত্রণ করে। আর আত্মা হচ্ছে দশম বুদ্ধি সত্তা হল Agent intelligence, যা ভূমণ্ডল বা পার্থিব জগতের সব গোলকের নিকটবর্তী বা অব্যবহৃত চালক, যা তার শক্তি বুদ্ধি থেকে অর্জন করে থাকে। আত্মা গোলকের প্রতি এক ধরনের আধ্যাত্মিক আকর্ষণের দ্বারা কার্যকরী হয়ে থাকে। আল-ফারাবি বলেন, প্রত্যেক গোলক এক আধ্যাত্মিক আকর্ষণের কারণে গতিশীল হয়। এ আকাঙ্ক্ষা বা আকর্ষণ নিম্নতর গোলক থেকে উচ্চতর গোলক এ পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা।

পদার্থবিদ্যার সাহায্যে দশম বুদ্ধি সম্পর্কিত মতবাদের ব্যাখ্যা: আল-ফারাবি মনে করেন, জ্যোতির্বিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। দশম বুদ্ধি থেকে মৌল জড় প্রবাহিত হয়ে থাকে, যা চারটি উপাদান এর মূল এবং একই বুদ্ধি থেকে বিভিন্ন আকারে প্রবাহিত হয়ে থাকে, যা দেহ উৎপন্নের জন্য জড়ের সাথে একত্রিত হয়। তিনি বলেন, পার্থিব জগৎ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আকারের ক্রম বা Series, যা বস্তু (Matter) এর সাথে যুক্ত বা বিযুক্ত হয়। তাঁর মতে, আকার ও জড়ের একত্রীকরণের ফল হল উৎপাদন এবং পৃথকীকরণের ফল হল ধ্বংস। তিনি মনে করেন, আবশ্যিক পরিবর্তনের জন্য সূর্যের গতি উষ্ণতা ও শীতলতা উৎপন্ন করে। অন্য সব পৃথক পৃথক বুদ্ধি পার্থিব জগতের জন্য উপযুক্ত গতি উৎপন্ন করে। এভাবে পদার্থবিদ্যা (Physics) বিশ্বতত্ত্বের (Cosmology) সাথে মিশে বা একীভূত হয়ে যায় এবং পার্থিব জগৎ ঐশি বা স্বর্গীয় জগতের অধীনস্থ হয়।

এভাবে আল-ফারাবি তাঁর Ten Intelligence Theory (দশম বুদ্ধি সম্পর্কীয় মতবাদ) এর দ্বারা গতি ও পরিবর্তনের সমস্যার সমাধান করেন। তিনি এক ও বহু সম্পর্কীয় সমস্যার সমাধানকল্পেও এ তত্ত্ব ব্যবহার করেন এবং এ তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি এরিস্টটলের জড় সম্পর্কীয় মতবাদ এবং ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কীয় মতবাদের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন দার্শনিকদের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে এটি ফারাবিয়ান তত্ত্ব। তিনি দর্শনের সাথে ধর্মের সঙ্গতি বিধানকালে যৌক্তিক ব্যাখ্যার সাহায্যে যেসব মত উপস্থাপন করেছেন সেগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এজন্যই তাঁর পদার্থবিদ্যা বিশ্বতত্ত্বে মিশে যায় এবং পার্থিব জগৎ স্বর্গীয় জগতের অধীন হয়ে পড়ে। তিনি দশম বুদ্ধি সম্পর্কীয় মতবাদের মাধ্যমে এক ও বহুর এবং গতি ও পরিবর্তনের সমস্যার যে ব্যাখ্যা দেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।