অথবা, খোদা সম্পর্কে আল-ফারাবির দার্শনিক চিন্তাধারা আলোচলা কর।
অথবা, আল-ফারাবির খোদাতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, খোদা সম্পর্কে আল-ফারাবির দার্শনিক চিন্তাধারা বর্ণনা কর।
অথবা, আল-ফারাবির খোদাতত্ত্ব সম্পর্কে যা জানা বিস্তারিতভাবে লেখ।
উত্তর: ভূমিকা: খোদাতত্ত্ব আল-ফারাবির অধিবিদ্যা সম্পর্কিত আলোচনার অন্তর্গত। আল-কিন্দি মুসলিম দার্শনিক ঐতিহ্যে যে সুফিবাদী ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন, আল-ফারাবি তাকে আরও সুদৃঢ় ও সুসংবদ্ধ করেন। আল-ফারাবির চিন্তাধারা দর্শনের ক্ষেত্রে বহুমুখী। খোদাতত্ত্ব সম্পর্কে আল-ফারাবির দার্শনিক চিন্তাভাবনা আলোচনা করাই আমাদের লক্ষ্য। জনের যে শাখা সত্তা, আল্লাহ, আত্মার স্বরূপ, বিকাশ, আল্লাহর সাথে মানুষ ও পৃথিবীর সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাকে আল-ফারাবি অধিবিদ্যা বলেছেন। নিম্নে আল-ফাঁরাবির ঘোদাতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা করা হলো:
খোদাতত্ত্ব: অধিবিদ্যার যে অংশে সত্তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে বলে সত্তাতত্ত্ব। খোদার প্রকৃতি, গুণাবলি, খোদার অস্তিত্বের প্রমাণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যে শাখা আলোচনা করে তাকে খোদাতত্ত্ব বলে।
আল-ফারাবি খোদাতত্ত্ব সম্পর্কে মাদিনাত আল ফাযিলাহ, সিয়াসাতু আল মাদানিয়া, ফুসুমুল হিকাম, কি মা ইয়ানবাগি আন মুকাদ্দামা বাবলা ভা’আলুম আল ফালাসিফা প্রভৃতি গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। খোদার গুণাবলি, খোদার মৌলিকত্ব, অপরিবর্তনশীলতা, একত্ববাদ, বিজ্ঞতা, নিত্যতা, খোদা সম্পর্কে উক্ত গ্রন্থাবলি অবলম্বনে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব কি না? খোদার অস্তিত্বের প্রমাণ এ আলোচনায় স্থান পাবে।
আল-ফারানির খোদার গুণাবলি সম্পর্কে অভিমত: খোদা শারীরিক ও যৌগিক সত্তা থেকে মুক্ত। খোদা অপরিবর্তনশীল। সাধারণত কোন বস্তু বাস্তব রূপ ধারণ করে সম্ভাব্য সুপ্ত শক্তির বিকাশের মাধ্যমে। শক্তির সুপ্ত স্তর থেকে বাস্তবতা পর্যন্ত অনেক স্তর অতিক্রম করতে হয়, যার ফলে পরিবর্তন ঘটে। এ ধরনের পরিবর্তন থেকে আল্লাহ মুক্ত। কারণ তিনিই প্রথম কারণ। যেখানে সুপ্ত শক্তির সংমিশ্রণে বিকাশের কোন সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ এক, যদি আল্লাহ এক না হয়ে একাধিক হয়, তাহলে তাদের প্রকৃতিতে বিভেদ ও বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। ফলে আল্লাহর মৌলিকত্ব খর্ব হয়। আবার যদি আল্লাহ একাধিক হয়, তাহলে স্বয়ংসম্পূর্ণতার গুণ তার উপর প্রযোজ্য হয় না।
কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, যদি আল্লাহ দু’জন হতো, তাহলে আসমান জমিনসমূহ ধ্বংস হয়ে যেত। কুরআনের বাণীর প্রতিধ্বনি আল-ফারাবির গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়। আল্লাহ জ্ঞানী, তিনি নিজেই তাঁর জ্ঞানের উৎস। তাঁর জ্ঞানের জন্য বাইরের কোন বস্তু বা ধারণার উপর নির্ভর করতে হয় না। তিনি বিজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। তিনি কোন উদ্দেশ্য সাধনের উপায় ও প্রয়োগ সম্পর্কে দক্ষ। তিনি বিজ্ঞ। যে জ্ঞান চিরস্থায়ী তা খোদার জন্য। নিজেকে আল্লাহ ভালোভাবে জানেন। জড়পদার্থ থেকে আল্লাহ মুক্ত। ফলে পৃথিবীর কোনকিছু তাঁর জ্ঞানের অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে না।
আল্লাহ চিরসত্য। সত্য ঘটনা এবং ধারণার সামঞ্জস্যের মধ্যেই নিহিত। খোদার কাছে বাস্তব ঘটনা ও কল্পিত ধারণা সবই এক। খোদা পরমসত্তা। সত্য ও পরমসত্তার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যিনি সত্য, তিনিই পরমসত্তা। আল্লাহ নিতা ও চিরঞ্জীব। পৃথিবীতে আমরা জন্মগ্রহণ করি আবার মৃত্যুবরণ করি। কিন্তু আল্লাহ সর্বদা বিরাজমান। তিনি অতীতে ছিলেন, বর্তমানে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন।
আল-ফারাবি আল্লাহর গুণাবলি বর্ণনার পদ্ধতি সম্পর্কে নঞর্থক এবং সদর্থক উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। খোদার উপর আরোপযোগ্য নয় এমন কিছু গুণ ব্যানা করার পর আল-ফারাবি সদর্থক গুণাবলির উল্লেখ করেছেন।
যেমন- খোদা পরনির্ভরশীলতা, পরিবর্তনশীলতা, সীমাবদ্ধতা, অসম্পূর্ণতা প্রভৃতি গুণাবলির উর্ধ্বে, অর্থাৎ এ ধরনের গুণাবলি খোদার জন্য প্রযোজ্য নয়। তিনি সদর্থক গুণাবলির বর্ণনা দিয়েছেন, যা খোদার শানে প্রযোজ্য, যেমন- সম্পূর্ণতা, বিজ্ঞতা, কল্যাণময়তা প্রভৃতি।
আল্লাহর প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের পক্ষে জ্ঞান লাভ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও জড়ের সাথে বন্ধন রয়েছে। এটা সত্য যে, আলোর মাধ্যমে কোন বস্তু দৃষ্টিগোচর হয়, তবে অতি উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা দৃষ্টিশক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। খোদা দর্শনের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। খোদার জ্ঞান সম্পূর্ণ, মানুষের জ্ঞান অসম্পূর্ণ। মানুষ সসীম, খোদা অসীম। ফলে সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে অসীমকে সম্যকভাবে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যখন মানুষ আত্মিক সাধনার বলে জড়ের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়, তখন সে খোদাকে জানতে পারে।
আল-ফারাবি খোদার অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে বলেন যে, এ পরিবর্তনশীল জগতের কথা চিন্তা করলে বুঝা যায়, এ বিশ্ব কতকগুলো অস্তিত্বশীল বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত। এ অস্তিত্বের কোন না কোন কারণ আছে এবং সে কারণের সৃষ্ট ফল হচ্ছে কার্য। আবার এ কার্য অন্য কোন বস্তুর কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে নিমিত্ত কারণের এ অনুক্রম অবাধ গতিতে অনন্ত ধারায় চলতে পারে না। সুতরাং এ কার্যকারণের অনুক্রমের বাইরে এমন এক নিমিত্ত কারণ রয়েছে, যার অস্তিত্বের জন্য অন্য কোন কারণের প্রয়োজন নেই। আল্লাহ হচ্ছেন এ অফারণিক নিমিত্ত কারণ। এ পৃথিবীর প্রত্যেকটা বস্তু গতিশীল। চালক থেকে গতিশীল বস্তু শক্তি সঞ্চয় করে। যদি চালিকাশক্তি নিজেই গতিশীল হয়, তবে তার পরিচালনার জন্য আরও একটি চালিকাশক্তির প্রয়োজন হবে এবং অনুক্রমিকভাবে এ ধারা চলতে থাকবে। কিন্তু সীমাহীনভাবে এ চালিকাশক্তি ও চালিত বস্তুর ধারাবাহিকতা চলতে পারে না। এমন কোথাও গিয়ে এ ধারাকে থামতে হবে যেখানে পরিচালিকাশক্তি অন্য কোন চালিকাশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। আল্লাহ হচ্ছেন নিজেই নিজের পরিচালক অর্থাৎ স্বপরিচালিত অস্তিত্ব।
মূল্যায়ন: খোদা সম্পর্কে আল-ফারাবির ধারণা মৌলিকত্বের স্বাক্ষর বহন করে। ম্যাকডোনাল্ডের মতে, “আল-ফারাবি ছিলেন মুসলিম দর্শন পিরামিডের ভিত্তিস্বরূপ।” খোদার অস্তিত্বের প্রমাণ সম্পর্কিত তিনি যেসব যুক্তির প্রদর্শন করেছেন, তাতে ইসলামি আকিদা এবং এরিস্টটলীয় চিন্তাচেতনার সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। তিনি কুরআন, হাদিস ও ইসলামি ভাবধারার আলোকে খোদার মৌলিকত্ব, অসীমতা, অপরিবর্তনশীলতা, একত্ববাদ, জ্ঞানময়তা, বিজ্ঞতা ও চিরঞ্জীবতা প্রভৃতি বিষয়ে ধারণা প্রদান করেছেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবির খোদাতত্ত্ব মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইবনে খাল্লিকানের মতে, “কোন মুসলিম চিন্তাবিদই দার্শনিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আল-ফারাবির ন্যায় অনুরূপ মর্যাদায় উন্নীত হতে পারেন নি।” তাঁর পদ্ধতি প্লেটোবাদ, এরিস্টটলবাদ এবং সুফিবাদের সৃজনমূলক সমন্বয় (Creative synthesis) বিশেষ। ফারাবি দার্শনিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে স্তরে উপনীত হযেছিলেন, অন্য কোন মুসলিম দার্শনিক ততদূর অগ্রসর হতে পারে নি। সুতরাং মুসলিম দর্শনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।