আল-ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্রের প্রত্যয় আলোচনা কর।

অথবা, আল-ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা আলোচনা কর।

অথবা, আল-ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্রের প্রত্যয় বর্ণনা কর।

অথবা, আল-ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাখ্যা কর।

অথবা, আল-ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: যে যুগে মুসলিম মনীষীগণ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছিলেন সেটা হল মধ্যযুগ। সে যুগে যেসব মুসলিম পণ্ডিতগণ নিজ সাধনা ও কর্মদক্ষতায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন তাদের মধ্যে আল-ফারাবি ছিলেন অন্যতম। আর এজন্য তাকে ‘Islamic representatine of political thinker’ বলে অভিহিত করা হয়। ম্যাকডোনাল্ড যথার্থই মন্তব্য করেছেন- আল-ফারাবি ছিলেন মুসলিম দর্শনের পিরামিডের মূল ভিত্তি।

আল-ফারাবির রাষ্ট্রের প্রত্যয়: নিয়ে আল-ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্রের প্রত্যয় আলোচনা করা হলো:

ক. রাষ্ট্রের উৎপত্তি: ফারাবির মতে, রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে মানব সমবায় থেকে চুক্তির মাধ্যমে। তাঁর মতে, মানবজাতি সুখশান্তি বিধানের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমবায় গড়ে তোলে। গ্রাম, শহর, জনপদ, রাষ্ট্র, জাতি সকলই সমবায় ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রই এ সমবায় ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ। গ্রাম, শহর বা অন্যান্য জনপদ পূর্ণাঙ্গ নয়। এরা রাষ্ট্রের অংশমাত্র। তাঁর মতে, রাষ্ট্র হচ্ছে সকল সমবায়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি আরও বলেছেন, গ্রাম ও নগর কালক্রমে জাতিতে রূপলাভ করবে। তিনি বিশ্বময় এক রাষ্ট্র গঠনের কথাও চিন্তা করেছেন।

আল-ফারাবি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে চুক্তিতত্ত্বের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, “ক্ষমতাশালী শ্রেণী ক্রোধ ও স্বার্থের বশীভূত হয়ে দুর্বল শ্রেণীর উপর অন্যায়ভাবে কর্তৃত্ব করে। যার ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।” এরূপ পরিস্থিতি হতে অব্যাহতি লাভের জন্য মানবশ্রেণী সম্মিলিতভাবে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী পরস্পরের অধিকার রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

খ. সরকার কাঠামো: আল-ফারাবি সরকারের শ্রেণীবিভাগের ব্যাপারে প্লেটোর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন। তিনি চার রকম দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের বিবরণ দিয়েছেন। যথা:

১. অজ্ঞাত নগরী: অজ্ঞাত নগরীকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এমন একটি নগরী হিসেবে যার অধিবাসীরা যথার্থ সুখ দেখে নি, সুখের অনুসন্ধানও করে নি; কিন্তু প্রলুব্ধ হয়েছে রকমারি ভ্রান্ত সুখের প্রলোভন দ্বারা।

২. একগুঁয়ে নগরী: একগুঁয়ে নগরী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে মহৎ নগরী থেকে স্বতন্ত্র। এর অধিবাসীরা আল্লাহ, মরণোত্তর জীবন এবং যথার্থ সুখের স্বরূপ সম্পর্কে ধাঁস করেছে বটে, কিন্তু সে মতে জীবন পরিচালিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

৩. স্বধর্মত্যাগী নগরী: স্বধর্মত্যাগী নগরী হল সে নগরী যেটি প্রথমে আলোচ্য আদর্শ ও মানদণ্ড মাফিক কাজ করলেও পরবর্তীকালে সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

৪. আন্ডিকর সপরী: ভ্রান্তিকর নগরী বলতে ফারাবি বুঝিয়েছেন সে নগরীকে, যা আল্লাহর প্রান্ত আন ছাড়া সঠিক আন ও যথার্থ সুখ কোনদিন অর্জন করতে পারে নি এবং যা বারবার এমন কোন তথাকথিত ননী দ্বারা শাসিত হয়েছে, দিদি নিজের লক্ষ্যার্জনের জন্য প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি আরও বলেছেন, আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্লেটোর মতই আদর্শ দার্শনিক শাসকের কথা কল্পনা করেন। তাঁর কাছে আল্লাহর নবী হযরত মুহম্মদ (স) ছিলেন প্লেটোর কল্পিত আদর্শ দার্শনিক শাসক। তিনি হলরত মুহাম্মদ (স) এর নাম উল্লেখ না করলেও সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, “একমাত্র বা প্লেটোনিক দর্শন সামগ্রিকভাবে ইসলাম জগতে সার্থক হয়ে উঠেছিল মানবিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনধারায়।” একথা বলে তিনি যে, রাসুলুল্লাহ (স) এর প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

গ. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব: সার্বভৌমত্বকে ফারাবি ‘রাইসুল আউয়াল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, ‘রাইসুল আউয়াল’ অন্য কারও যারা পরিচালিত বা অদিষ্ট হবেন না, বরং তাঁর আদেশই অন্য সকলের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় হবে। ফারাবির সার্বভৌমত্ব নীতির ভিত্তিতেই ফরাসি দার্শনিক জেন বডিন ষোড়শ শতাব্দীতে তাঁর চরম সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি ঠিক ফারাবির মত তাঁর সার্বভৌমকে চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে যেতে পারেন নি। এদিক দিয়ে ইংরেজ আইনবিদ জন অস্টিনই ফারাবির উত্তরসূরি। ফারাবি বলেছেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য মানবের হুকুম শাসক পালন করবেন না। বাস্তব ঘটনাবলি হতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও তাঁর থাকবে। তিনি হবেন রাষ্ট্রের সার্বভৌম শাসক। তাঁর উপর আর কোন Human Superior থাকবে না।

ঘ. মহৎ রাষ্ট্র: রাষ্ট্রকে ফারাবি কতকগুলো বিমূর্ত উদ্দেশ্যবাদী নীতির ভিত্তিতে শ্রেণীবিভক্ত করেছেন। মহৎ রাষ্ট্র বলতে তিনি বুঝিয়েছেন এমন রাষ্ট্রকে যেখানে শুভ বা আনন্দময় জীবনের চর্চা করা হয় এবং যেখানে গুণী ব্যক্তি তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।

ঙ. মহৎ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের গুণাবলি: মহৎ বা আদর্শ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে আল্লাহ প্রদত্ত নেতৃত্বগুণ ছাড়াও তাঁকে প্লেটোর দার্শনিক রাজার মত বুদ্ধি, প্রখর স্মরণশক্তি, মনের তীক্ষ্ণতা, জ্ঞানানুরাগ, খাদ্য পানীয়ের ব্যাপারে সংযম, সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগ, মহত্ত্ব ও মিতব্যয়িতা, ন্যায়ানুরাগ, দৃঢ়তা, সৎসাহস তথা দৈহিক সুস্থতা ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রভৃতি মহৎ গুণের অধিকারী হতে হবে।

ফারাবির মতে, শাসকের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে রাষ্ট্রের ব্যাপক ও স্থায়ী কল্যাণ। এজন্যই প্লেটোর ন্যায় ফারাবির প্রস্তাব, ব্যাপক রাষ্ট্রীয় কল্যাণ এবং জনগণের শান্তি ও প্রগতির পথ সুগম করতে হলে রাষ্ট্রের শাসনভার অর্পণ করতে হবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও নিষ্কলঙ্ক চরিত্র দার্শনিকের উপর।

চ. রাজ্যজয়: রাজ্যজয় বা প্রাধান্য বিস্তারকে যারা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে মনে করেন, ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে এ ধারণা তাঁদের দেওয়া প্রাকৃতিক ন্যায়পরায়ণতার ধারণার বিপরীত। এ মতের প্রতি পরোক্ষ কটাক্ষ করে ফারাবি বলেছেন, যুদ্ধকে যুক্তিযুক্ত বলা যায় কেবল তখনই, যখন তা আক্রমণ প্রতিহত করার কিংবা রাষ্ট্রের অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে, পরিচালিত হয়, ভূখণ্ড বিজয়ের বা অন্য কোন লাভের আশায় পরিচালিত হলে নয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবির রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কাঠামো, সার্বভৌমত্ব প্রভৃতি বিষয়ে মৌলিক রাষ্ট্রদর্শনের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি বলেন, শাসকের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার উপরই নির্ভর করে রাষ্ট্রের ব্যাপক ও স্থায়ী কল্যাণ। সুতরাং আল-ফারাবির রাষ্ট্রের প্রত্যয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।