অথবা, লর্ড ডালহৌসিকে কেন আধুনিক ভারতের জনক বলা হয়?
অথবা, লর্ড ডালহৌসিকে ভারতের আধুকিন জনক হিসেবে তার সম্বন্ধে ধারণা ব্যাখ্যা দাও।
উত্তর: ভূমিকা: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতিতে যে ক’জন গভর্নর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন লঙ্ ডালহৌসি তাদের মধ্যে অন্যতম। লর্ড হার্ডিঞ্জের পর ১৮৪৮ সালে গভর্নর জেনালের হয়ে এসেই লর্ড ডালহৌসি ভারতের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। দেশীয় রাজন্যবর্গের শাসন অপেক্ষা ব্রিটিশ শাসন অধিকতর মঙ্গলকর হবে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারনীতি প্রবর্তন করেন। ডালহৌসি সম্পর্কে রিচার্ড টেম্পল বলেন, “ইংল্যান্ড যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভারত শাসনের জন্যে পাঠায়, তাদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসক হিসেবে কেউ কদাচিৎ ডালহৌসির সমকক্ষ হলেও তাকে অতিক্রম করতে পারেন নি।”
আধুনিক ভারতের জনক বলার কারণ: লর্ড ডালহৌসি ১৮১২ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। এদেশে আসার পূর্বে তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। ১৮৪৮ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। একজন সাম্রাজ্যবাদী শাসক হিসেবে তিনি অধিক পরিচিতি পেলেও তার সংস্কার কার্যাদি যে ভারতীয় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করেছিল একথা অনস্বীকার্য। তার সময় থেকেই আধুনিক ভারতে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ভিত্তি রচিত হয়। এ কারণে তিনি আধুনিক ভারতের জনকের আখ্যা পেয়েছেন। নিম্নে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেওয়া হলো:
(ক) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে: ডালহৌসি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভৃত উন্নতি সাধন করেন। নিম্নে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেওয়া হলো:
১. সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন: তিনি ১৮৫৪ সালে কৃষিকাজে সেচ ব্যবস্থার প্রসারের জন্য গঙ্গা খাল প্রকল্প অধিকতর প্রসারিত করেন। এক্ষেত্রে ডালহৌসি বারো লক্ষ ত্রিশ হাজার পাউন্ড ব্যয় করে এ সেচ খাল খননের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। করার প্রয়াস পান। রাজ্যজয়ের ফলে অর্জিত রাজস্বের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
২. রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি : তার আমলে নতুন নতুন এ অতিরিক্ত রাজস্ব তিনি বিভিন্ন জনহিতকর কাজে ব্যবহার
৩. রেললাইন স্থাপন: ডালহৌসির সময়েই প্রথম ভারতে রেললাইন স্থাপিত হয়। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে রেলের গুরুত্ব অনুধাবন করেই তিনি রেল যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী হন। ১৮৫৩ সালে সর্বপ্রথম বোম্বাই এলাকায় রেললাইন স্থাপন করেন।
৪. বনভূমি সংরক্ষণনীতি: বনভূমি সংরক্ষণ নীতি প্রবর্তন করে ডালহৌসি প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যবস্থা করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বনভূমির মাঝে প্রাকৃতিক আবহাওয়ার সম্পর্ক নিবিড়। তাই তিনি বনভূমি সংরক্ষণ নীতি প্রয়োগ করেছিলেন।
(খ) সামাজিক ক্ষেত্রে: পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অকৃত্রিম সাহায্য ও সহযোগিতায় তিনি বিধবা বিবাহ আইন পাস করেন হিন্দু বিধবা বিবাহকে আইনসঙ্গত করেন। তিনিই আইনের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত ভারতবাসীকে পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার প্রদান করেন। এসময় সেনাবাহিনীতে হিন্দু সিপাহীদের মধ্যে সমুদ্র যাত্রা ধর্মীয় বিধান বিনাশ হিসেবে বিবেচিত হতো, ডালহৌসি অযৌক্তিক কুসংস্কার হতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সৈন্যদের মুক্ত করার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
(গ) শিক্ষা বিষয়ক সংস্কার: লর্ড ডালহৌসি এ উপমহাদেশে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট স্যার উডের সাহায্যে শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশ পত্র নামক একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। ১৮৫৫ খ্রিঃ শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশপত্র আধুনিক ভারতের শিক্ষা পদ্ধতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। একে এদেশে বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।
১. সরকারি অনুদান প্রদান: লর্ড ডালহৌসি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্যে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
২. নারীশিক্ষার সম্প্রসারণ: লর্ড ডালহৌসি নারী শিক্ষারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার উৎসাহে এবং কাউন্সিলের সদস্য বেথুন সাহেবের চেষ্টা কলকাতায় বেথুন মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ঘ) শাসন ক্ষেত্রে: উপরিউক্ত উন্নয়নমূলক সংস্কারগুলো ছাড়াও ডালহৌসি শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। তার গৃহীত উন্নত শাসনব্যবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষার্থে কাজ করতো। বঙ্গদেশ শাসনের জন্য তিনি একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করেন। পাঞ্জাব এবং বার্মাতেও তিনি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। লর্ড ডালহৌসির সার্বিক কৃতিত্বের জন্যই ভারতবর্ষে অমর হয়ে আছেন এবং আধুনিক ভারতের জনক আখ্যায়িত হয়েছেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, লর্ড ডালহৌসি একজন সার্থক শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাবসম্পন্ন শাসক। “একজন রাজকীয় প্রশাসক হিসেবে ডালহৌসি প্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে কারও অপেক্ষা নিম্নমানের ছিলেন না। বরং তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি একদিকে যেমন ব্রিটিশ স্বার্থসংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়েছেন, অন্যদিকে ভারতবর্ষের উন্নতিকল্পেও অনেক কিছু করেছেন।