অথবা, আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে দার্শনিকদের বিরুদ্ধে ইমাম আল গাজ্জালির মত ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে ইমাম আল-গাজালির মতবান আলোচনা কর।
অথবা, আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে ইমাম আল-গাজালি কিরূপ মতবাদ ব্যক্ত করেন।
উত্তরঃ ভূমিকা: ইমাম আল গাজালি ছিলেন মুতাজিলা সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। তিনি ইসলামকে ইসলামের পরিপন্থী সকল প্রকার প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। তিনি ইসলামে গ্রিক দর্শনের প্রস্তাবকে খর্ব করেন। তাঁর মতে, আল্লাহর প্রেম ইসলামের সারসত্তা একে এ জগতে মানবজীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে অভিহিত করেন। কিছু কিছু ধর্মতত্ত্ববিদ আল্লাহর প্রতি মানুষের প্রেম সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। সুতরাং আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে গাজালির মতবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে ইমাম আল গাজ্জালি : মুসলিম দার্শনিকগণ আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করেন। এমনকি অমুসলিম দার্শনিকরাও আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সদর্থক ধারণা ব্যক্ত করেন। ইমাদ আল গাজালি আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মানবজাতিকে তিন ভাগে ভাগ করেন। যেমন-
১. সত্যানুসারী দল,
২. দাহরিয়া বা জড়বাদী দল,
৩. দার্শনিক দল।
১. সত্যানুসারী দল: যারা আল্লাহকে বিশ্বাস এবং যারা মনে করে সৃষ্টিকর্তা আছে তাদেরকেই সত্যানুসারী দল বলা হয়। তারা সৃষ্টিকর্তাকে অসীম ও দয়ালু মনে করে। সত্যানুসারী দল জগৎকে সৃষ্ট বলে মনে করে।
২. সাহরিয়া বা জড়বাদী দল: জড়বাদীরা মনে করে, জগৎ অনাদি ও অনন্ত। জগৎ কখনো সৃষ্টি হয় নি। তাই এ জগতের কোন সৃষ্টিকর্তারও দরকার নেই। জগৎ অনন্তকাল ধরেই ছিল।
৩. দার্শনিক দল: দার্শনিকদের মতে, জগৎ অনাদি ও অনন্ত। জগৎ অনাদি ও অনন্ত হওয়া সত্ত্বেও জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছে। আর এ সৃষ্টিকর্তাই হলো খোদা বা ঈশ্বর। সত্যানুসারী দলকে ইমাম আল গাজালি সমর্থন করেন। জড়বাদী দলকে তিনি অযৌক্তিক মনে করেন এবং দার্শনিকদের যুক্তিসমূহেরও তিনি সমালোচনা করেন।
দার্শনিকদের যুক্তি: দার্শনিকদের মতে, জগৎ অনাদি ও অনন্ত। জগৎ অনাদি ও অনস্ত হওয়া সত্ত্বেও দার্শনিকরা আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন। তাই তাদের যুক্তিসমূহ নিম্নরূপ:
প্রথমত, জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছে। এ সৃষ্টিকর্তাই হলেন আল্লাহ বা ঈশ্বর। তিনি জগতের একজন কারণ। তিনিই জগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এ সবকিছু সৃষ্টির মহানায়ক হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ।
দ্বিতীয়ত, দার্শনিকরা মনে করেন, জগতের মূলে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে। আর এ স্রষ্টার অস্তিত্ব অবশ্যই প্রমাণ করা যায়। জগতের প্রত্যেকটি ঘটনার পিছনে একটি কারণ রয়েছে। এ কারণই হচ্ছে আদি কারণ। আর এ আদি কারণই হচ্ছে ঈশ্বর বা খোদা।
তৃতীয়ত, দার্শনিকরা মনে করেন যে, কোন প্রাণীরই কোন পারস্পরিক সম্পর্ক নেই। এদের সাথে কোন সম্পর্কও আরোপ করা চলে না। দার্শনিকরা আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। তারা আল্লাহকে একজন পরিচালক হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন।
চতুর্থত, দার্শনিকদের মতে, কারণসমূহের এক একটির প্রত্যেকটিই নিজে নিজে সম্ভব। আর যদি সম্ভব হয় তাহলে কারণের কোন দরকারই নেই। দার্শনিকরা আরো বলেন, সমগ্র সম্ভব। আর সমগ্র সম্ভব বলেই কারণের অবশ্যই দরকার আছে। আর কারণ আছে বলেই আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করতেই হয়।
পঞ্চমত, কিছু দার্শনিক মনে করেন যে, দেহের সাথে আত্মা সংযুক্ত হওয়ার আগে একটি বিশ্বাত্মার সাথে আদিতে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু অন্য দার্শনিকরা মনে করেন যে, দেহ ব্যতীত আত্মার কোন বিনাশ নেই।
দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল গাজালির যুক্তি: আল গাজালি উপর্যুক্ত যুক্তিগুলো খণ্ডন করে প্রমাণ করতে চান যে,। দার্শনিক কখনো আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেন নি। তাই দার্শনিকদের বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তিগুলো নিম্নরূপ:
১. আল গাজালির মতে, দার্শনিকগণ যে আদি কারণের কথা বলেছেন তা যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। তা অনুমানের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আল্লাহর অস্তিত্ব এর দ্বারা অস্বীকৃতিমূলক।
২. দার্শনিকরা যে কার্য ও কারণের কথা বলেছেন আল গাজালি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি কার্যকারণের পূর্বগামিতাকে গ্রহণ করতে পারেন নি।
৩. দার্শনিকরা প্রাণসমূহের সম্পর্কের ব্যাপারে যে কথা বলেছেন সেটা আল গাজালি মেনে নিতে পারেন নি। গাজালি বলেন, তারা প্রাণসমূহের ব্যাপারে যে কথা বলেছেন তার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
৪. দার্শনিক সম্ভব ও অসম্ভব কথাগুলো প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করতে পারেন নি। তাই গাজালি এর বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তারা সম্ভব ও অসম্ভব কথাগুলো অস্থায়ী অর্থে ব্যবহার করেছেন।
৫. যদি আত্মা বিশ্বাত্মার অংশ হয় তাহলে তা কখনো প্রমাণ করা যায় না। আর যদি আত্মা নিজেই সৃষ্টি হয় তাহলে তা এক অসীম সৃষ্টি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অসীম সৃষ্টি হিসেবে কখনো এটাকে ব্যবহার করা যায় না।
মন্তব্য: আল গাজালি দার্শনিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন, জগতের অনাদিত্বে যারা অবিশ্বাস করেন না, খোদার সাথে অন্য কোন সত্তাকে যারা অনন্ত, অনাদি ও অসীম মনে করেন তারা কখনো আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেন না। আল্লাহ সবসময়ই ছিলেন। তিনি অনন্ত, অসীম ও দয়ালু। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে। তার সাথে অন্য কোন কিছুর তুলনা হয় না। এ জগতের সবকিছুই তাঁর দ্বারা সৃষ্টি। এভাবে আল গাজালি দার্শনিকদের মতবাদ খণ্ডন করেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, মুসলিম চিন্তা জগতে ও বিশ্ব ইতিহাসে আল গাজালির নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে আল গাজালি যে অভিযোগ করেছেন তার কোন যৌক্তিক ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। আল্লাহর জান সম্পর্কে আল গাজালি সম্ভবত দার্শনিকদের প্রকৃত ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে সক্ষম হন নি। আল গাজালি দার্শনিকদের বিরুদ্ধে যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে প্রশংসনীয়।