অথবা, “কার্যকারণের মধ্যে কোন আবশ্যিক সম্পর্ক নেই” -আল গাজালি কিভাবে তা প্রমাণ করেছেন? তাঁর মত কিভাবে হিউমের মত থেকে ভিন্ন?
অথবা, কার্যকারণ নীতি সম্পর্কে আল গাজ্জালির ধারণা আলোচনা কর। এ বিষয়ে তাঁকে হিউমের সাথে তুলনা কর।
অথবা, আল গাজালি কিভাবে দেখান যে, “কার্যকারণের মধ্যে কোন আবশ্যিক সম্পর্ক নেই।” এ বিষয়ে তাঁর মতবাদ ও হিউমের মতবাদের পার্থক্য কী?
উত্তরঃ ভূমিকা: একাদশ শতকে ইসলাম ও মুসলিম জগতের এক চরম সংকটকালে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ তথা ইমাম আল গাজালির আবির্ভাব (১০৫৮-১১১১ খ্রি.) একদিকে সমগ্র খ্রিস্টান ইউরোপে মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য কাজ শুরু করে। অন্যদিকে, স্পেনেজের গৌরবজ্জ্বল মুসলিম রাজশক্তিকে নস্যাৎ করার জন্য অগ্রসর হয়। এ চরম যুগসন্ধিক্ষণে ইমাম আল গাজালি লেখনী শক্তি ও প্রখর মেধাশক্তি দ্বার। ইসলামকে নব প্রাণরসে সঞ্জীবিত করেন।
কার্যকারণ নীতি সম্পর্কে গাজালি: দেহের পুনরুত্থানের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে দার্শনিকরা কার্যকারণ দেয়ায় গাজালি তাদের সেই কার্যকারণ বিষয়ক মতের তীব্র সমালোচনা করেন এবং তারই ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান মরণোত্তর জীবনের সম্ভাবনাকে। জগতের বস্তু নির্ণয়ের কার্যকারণ তত্ত্ব সম্পর্কে আল গাজালি যে অভিনব মতবাদ উপস্থাপিত করেন তা দর্শন জগতে এক নতুন ভাবনার দিক খুলে দেয়। গাজালি তার আলোচনা শুরু করেন দার্শনিকদের কার্যকারণ তত্ত্বের দুটি দিকের বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা দ্বারা।
প্রথমত, দার্শনিকদের মতে, কার্য ও কারণের সম্বন্ধ অনিবার্য ও আবশ্যিক। অর্থাৎ কারণ থাকলে কার্য অবশ্যই থাকবে এবং কার্য সংঘটিত হলে বুঝতে হবে যে, এর অবশ্যই একটি কারণ আছে।
দ্বিতীয়ত, দার্শনিকরা মনে করেন যে, “কার্য ও কারণের মধ্যে সম্বন্ধ একের সঙ্গে একের সম্বন্ধ” অর্থাৎ তাঁদের মতে, একটি কার্যের একটি কারণ এবং একটি কারণের একটিই কার্য থাকবে।
আল গাজালি দার্শনিকদের এ ধারণা চ্যালেঞ্জ করেন। প্রথম ধারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কার্য ও কারণের মধ্যে কোন বাধ্যতামূলক আবশ্যিকতা নেই। যেমন- আগুন ও দাহিকা শক্তির সম্পর্ক কিংবা পানি পান ও পিপাসা নিবৃত্তির সম্পর্কের কথা। এসব সম্বন্ধের মধ্যে এমন কোন অনিবার্যতা লক্ষ্য করা যায় না। অর্থাৎ কার্য ও কার্যকারণের সম্বন্ধের বেলায় আমাদের মন একটি ধারণা থেকে আর একটি ধারণার কোন অনিবার্যতা বা বাধ্যতা দ্বারা পরিচালিত হয় না। এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির অস্তিত্বকে অনিবার্যভাবে প্রতিষ্ঠিতও করে না। যেমন- আমরা এও ভাবতে পারি যে, আগুন আছে ঠিকই কিন্তু সেই আগুন আর দহন করে না অথবা পানি আছে কিন্তু তা আর পিপাসা নিবৃত্তি করছে না। এ ধরনের ঘটনা হয়তো এখনো ঘটে নি কিন্তু ঘটলেও তা ভাবার মধ্যে কোন যৌক্তিক বাধা বা স্ববিরোধিতা নেই।
গাজালির মতে, এর কারণ অনুধাবন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। আগুন ও দাহিকার কথাই বলি এসবই প্রাকৃতিক ব্যাপার। আর দার্শনিকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে, এসব প্রাকৃতিক ব্যাপার, সম্ভাব্যতার ব্যাপার, অনিবার্যতার ব্যাপার নয়। কার্য ও কারণ হিসেবে চিহ্নিত যে কোন দুটি প্রাকৃতিক ঘটনা নিতান্তই দুটি সম্ভাব্য ঘটনা এবং সে কারণেই তাদের মধ্যে কোন অনিবার্য সম্পর্ক থাকতে পারে না। প্রাকৃতিক ও সম্ভাব্য ব্যাপারে কোন যৌক্তিক অনিবার্যতা প্রযোজ্য নয়। যৌক্তিক অনিবার্যতা কেবল বার বার পূর্বাপর ঘটতে দেখি তখন নিতান্তই অভ্যাসবশত আমরা তাদের অভিজ্ঞতার জগৎ – থেকে চিন্তার জগতে স্থানান্তরিত করে ফেলি এবং এদের পূর্বাপর সম্বন্ধের মধ্যে অনিবার্যতার আভাস লক্ষ্য করি। কারণ ও কার্যকে পর পর সংঘটিত হতে দেখা গেছে ঠিক কিন্তু কার্য যে প্রকৃতি দ্বারা সংঘটিত হয়েছে তা কখনো প্রত্যক্ষ করা হয় নি। তাই কারণ যে কার্যের স্রষ্টা এরুথা হলফ করে বলা যায় না।
গাজালির মতে, কোন প্রাকৃতিক বস্তু এমন কি নভোমণ্ডলের কোন সত্তা ও প্রকৃত কারণ হতে পারে না। কারণ এরা সবাই নিষ্প্রাণ ও নির্জীব। এ বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড এবং এর যাবতীয় গতিপ্রকৃতি আল্লাহ দ্বারা পরিচালিত। আল্লাহ অতিপ্রাকৃত সর্বশক্তিমান সত্তা। তিনি পরিচালিত নিজস্ব স্বাধীন ইচ্ছা প্রাকৃতিক কার্যকারণ ও এর অনিবার্যতা দ্বারা নয়। আল গাজালি কুরআনের মতবাদ সমর্থন করেন। কুরআনে উক্তি আছে, ‘কুন ফাইয়া কুন’ (খোদা বলেন, হও এবং জগৎ সৃষ্টি হলো)। এছাড়াও নিরপেক্ষ সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে আল্লাহ্ নিজ ইচ্ছায় এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং গাজালির মতে, এ জগৎ খোদার ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ। এভাবেই আল গাজালি প্রাকৃতিক কার্যকারণ তত্ত্বকে খণ্ডন করেন এবং কার্যকারণ সম্পর্ককে কালিক সম্পর্কে রূপান্তরিত করেন।
এছাড়াও গাজানি বলেন, দার্শনিকরা কার্যকারণের সম্বন্ধকে যে একের সঙ্গে একের সম্পর্ক বলে মনে করেন তা ঠিক নয়। প্লেটোনীয় বিকিরণবাদের প্রতি অতিশয় আকর্ষণে বশবর্তী হয়েই তারা এ ভুল ধারণা পোষণ করেন। কারণ জিনিসটি কোন এককধর্মী বস্তু বা ঘটনা নয়। এটি এমন একটি মিশ্র জিনিস যার পেছনে কিছু নঞর্থক শর্ত কাজ করে। তাই কোন কারণের পূর্ণাঙ্গ প্রকৃতি জানতে হলে এ ধরনের সব শর্ত সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। যেমন- কোন একটি বস্তুকে দেখার মতো একটি সহজ বস্তুর পেছনেও অনেকগুলো জটিলতা রয়েছে। যেমন- তা আমাদের দৃষ্টি আলো বায়ুতে ধূলি কিংবা ধোঁয়ার অনুপস্থিতিতে বস্তুটির অবস্থান এবং আমার কাছ থেকে এর দূরত্ব প্রভৃতি অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। শধু তাই নয়, একটি কার্য কোন একটি একক কারণ দ্বারা নয়। অনেক কারণ দ্বারা পৃথকভাবে সংঘটিত হতে পারে। আর এসব বিশেষ কারণ আমাদের প্রত্যক্ষিত কারণের বাইরে থাকাও বিচিত্র নয়। কারণ আমাদের প্রত্যক্ষ শক্তি নিত্যন্তই সীমিত।
কার্যকারণ বিষ্যাক আল গাজালির উপর্যুক্ত বিশ্লেষণকে মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এক মৌলিক বলে প্রশংসা ব্যক্ত হয়েছে। তবে এ বিশ্লেষণে তিনি হাত দিয়েছিলেন অসাধারণ বা অলৌকিক ঘটনার সম্ভাব্যপরতা তথা দেহের মরণোত্তর পুনরুত্থান প্রমাণের উদ্দেশ্যে। কার্যকারণ তত্ত্বের দিক থেকে আল গাজালিকে হিউমের পূর্বসূরী বলা যায়। অর্থাৎ হিউম কার্যকারণ সম্পর্কের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করেন। আধুনিক কালে দার্শনিক ডেভিড হিউম কার্যকারণ সম্পর্কের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ইমাম আল গাজালি যথেষ্ট বলিষ্ঠতার সাথে কার্যকারণ মতবাদের আীনবার্যতাকে অস্বীকার করেছেন এবং নিজস্ব যুক্তির ও আল্লাহর প্রদত্ত ধারণার মাধ্যমে একে ঘটনার পারম্পর্য বলে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া কার্যকারণ সম্পর্কের অনিবার্যতাকে তিনিই প্রথম অস্বীকার করেছেন। তাই তিনি হিউমের পূর্বসূরীও বটে।