ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা শাসকদের গুণাবলির প্রেক্ষিতে আল গাজালির অভিমত ব্যাখ্যা কর।

অথবা, আল গাজালির মতে ইসলামি রাষ্ট্রের কী কী গুণ থাকা উচিত? ব্যাখ্যা কর।

অথবা, একজন আদর্শ ও যোগ্য শাসবের কী কী গুণ থাকা উচিত বলে আল গাজালি মনে করেন?

অথবা, আল গাজালির মতে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের কিরূপ গুণাবলি থাকা উচিত? বর্ণনা কর।

অথবা, আল গাজালির মতানুসারে ইসলামী রাষ্ট্রের কী কী গুণ থাকা উচিত বিস্তারিত আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম জাহানের ভিতরে ও বাইরে এক চরম সংকট বিরাজ করছিল। সমগ্র খ্রিস্টান মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিকে নস্যাৎ করার জন্য কাজ শুরু করে। অন্যদিকে, স্পেনের গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম রাজ শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হয়। এমতাবস্থায় হুজ্জাতুল ইসলাম তথা আল গাজালির আবির্ভাব ঘটে। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন এবং ইসলামকে নব প্রাণরূপে উজ্জীবিত করে তোলেন। তিনি মুসলিম, ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল করে আছেন।

ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের গুণাবলি সম্পর্কে আল গাজালি: ইমাম আল গাজালি রাষ্ট্রপ্রধানদের গুণাবলি সম্পর্কে তাঁর ‘তীররুল সজরুম’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। গাজালির মতে, রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য একজন যোগ্য শাসকের যেসব গুণাবলি রয়েছে, তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. ন্যায়বিচারক: আল গাজালির মতে, রাষ্ট্রের শাসক হবেন ন্যায়বিচারক। তাঁর মতে, আইনের দূরিতে সবাই সমান এবং বেআইনিভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না- বর্তমানে এ গণতান্ত্রিক নীতি শাসককে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পাসক অন্যায়কে কখনো প্রশ্রয় দিবেন না। তাঁর মতে, ‘শাসনকার্য পরিচালনার সময় শাসক প্রভাবশালী কার্যে দ্বারা প্রভাবিত হবেন না।

২. ধার্মপরায়ণ: গাজালির মতে, আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক হবেন ধর্মপরায়ণ। কারণ ইহলোকিক সুধের সাথে সাথে পারলৌকিক জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভ করতে হলে শাসক ও শাসিত উভয়কেই আল্লাহর হুকুম যথাযথভাবে পালন করতে হবে। সুতরাং যোগ্য শাসককে অবশ্যই ধর্মপরায়ণ হতে হবে।

৩. দূরদৃষ্টি সম্পন্ন: আদর্শ রাষ্ট্রের শাসককে অবশ্যই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হবে। রাষ্ট্র শুধু বর্তমান অবস্থা নিয়ে আবর্তিত নয়, অতীত এবং ভবিষ্যতকে নিয়ে আবর্তিত হয়। অতীতে কি ঘটেছিল, বর্তমানে কি ঘটছে এবং ভবিষ্যতে কি ঘটবে তার একটি স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে শাসককে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে।

৪. মেধাবী ও পরাক্রমশালী: গাজালির মতে, রাষ্ট্রের শাসককে অবশ্যই মেধাবী ও পরাক্রমশালী হতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। রাষ্ট্রের মধ্যে যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেদিকেও শাসককে খেয়াল রাখতে হয়। তাই রাষ্ট্রের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব একজন মেধাবী ও পরাক্রমশালী শাসকের।

৫. চরিত্রবান: আল গাজালির মতে, রাষ্ট্রের শাসককে অবশ্যই চরিত্রবান হতে হবে। তাঁকে উন্নত চরিত্র ও মন মানসিকতার অধিকারী হতে হবে। তাকে হযরত মুহাম্মদ (স) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করতে হবে। রাষ্ট্রের জনগণ সবসময়ই চায় রাষ্ট্রের শাসক হবেন একজন চরিত্রবান ব্যক্তি।

৬. আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণ: আল গাজালির মতে, যে ব্যক্তি চরম নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর বাণী ও নির্দেশ অনুসরণ করেন এবং আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষদের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করেন তিনি আদর্শ শাসক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

৭. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: আল গাজালির মতে, রাষ্ট্রপ্রধানকে আইনের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। রাষ্ট্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে শাসককে কঠোরভাবে ইসলামি আইনের অনুসারী হতে হবে। রাষ্ট্রের মধ্যে কেউ অন্যায় করলে আইনের মাধ্যমে তাকে শাস্তি দিতে হবে।

৮. গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল: এগারো শতকের আগে ও পরে গণতান্ত্রিক কোন কোন ব্যবস্থা না থাকলে ও তিনি শাসককে জনগণের প্রতি গণতান্ত্রিক আচরণ করার কথা বলেছেন। অর্থাৎ তিনি জনগণের মতামত অনুযায়ী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলেছেন।

৯. বিচারবুদ্ধি ও বিবেক সম্পন্ন: গাজালি রাষ্ট্রকে জীবদেহ ও শাসককে রাষ্ট্রের হৃদয়ের সাথে তুলনা করেছেন। মানব মনে যেমন থাকে কামনা, ক্রোধ, বিচারবুদ্ধি ও বিবেকবোধ তেমনি রাষ্ট্রে রয়েছে শাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থা।

১০. সাহসী: গাজালির মতে, রাষ্ট্রের শাসককে সাহসী হতে হবে। সাহসী না হলে তাঁর দ্বারা কখনো রাষ্ট্রপরিচালনা করা সম্ভব নয়। ভয় এবং আশঙ্কা নিয়ে কাজ করে রাষ্ট্রপরিচালনা করা সম্ভব নয়।

১১. শারীরিকভাবে সক্ষম: গাজালির মতে, আদর্শ শাসক হবেন শারীরিকভাবে সক্ষম। শাসক যদি শারীরিকভাবে সক্ষম না হন তাহলে রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পাদন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়া শাসকের অন্যতম গুণাবলি।

১২. উদারনৈতিক: একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। এখানে শাসক যদি নিজ জনগণের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকায় তাহলে তাকে যোগ্য শাসক বলা যাবে না। রাষ্ট্রের শাসককে উদার মানসিকতা সম্পন্ন ও মহৎ গুণের অধিকারী হতে হবে।

১৩. জ্ঞানী: গাজালির মতে, একজন যোগ্য শাসককে অবশ্যই জ্ঞানী ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে। জ্ঞানী না হলে রাষ্ট্রপরিচালনা করা সম্ভব নয়। জ্ঞানী শাসক তাঁর জ্ঞান দ্বারা রাষ্ট্রকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাবে।

১৪. জনগণের কল্যাণসাধন: একজন আদর্শ শাসক সবসময় জনগণের কল্যাণের কথা ভাবেন। কিভাবে জনগণের কল্যাণসাধন করা যায় এবং কিভাবে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে তিনি সবসময় ব্যস্ত থাকবেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, গাজালি ছিলেন একজন গবেষক। তিনি শাসকের যেসব গুণাবলির কথা বলেছেন তা সব মহলে প্রশংসার দাবিদার। তিনি মুসলিম জাহানের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। তিনি যোগ্য শাসকের যে গুণাবলির কথা বলেছেন তার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।