অথবা, আল গাজ্জালির সন্দেহবাদ ব্যাখ্যা কর। ডেকার্ট ও হিউমের সাথে তাঁর বৈসাদৃশ্য ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আল গাজালির সংশয়বাদ আলোচনা কর। এ প্রসঙ্গে ডেকার্ট ও হিউমের মতবাদের সাথে তাঁর মতাবাদের ভিন্নতা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আল গালির সংশয়বাদ বর্ণনা কর। তাঁর সাথে ডেকার্ট ও হিউমের সতবাদের কী পার্থক্য রয়েছে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: খ্রিস্ট্রীয় একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম জাহানের বাইরে ও ভিতরে যখন চরম সংকট বিরাজ করছিল ঠিক তখনই ইমাম আল গাজালির (১০৫৮-১১১১ খ্রি) আবির্ভাব ঘটে। তিনি আশারিয়া সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ও মৌলিক চিভাবিদ ছিলেন। কারো কারো মতে, হযরত মুহাম্মদ (স) এর পর যদি আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটতো তাহলে আল গাজালিই হতেন সেই ব্যক্তি। তিনি তাঁর দার্শনিক মতবাদে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের ইতিহাসে বিকশিত সবগুলো আধ্যাত্মিক মত ও পথের রূপায়ণ ও সংস্কারসাধনের চেষ্টা করেছিলেন।
আল গাজালির সংশয়বাদ: আল গাজালি তাঁর দার্শনিক আলোচনা আরম্ভ করেন ডেকার্টের মতো সংশয়বাদ দিয়ে। সত্যের সন্ধান এবং কোন কিছু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সংশয়বাদকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান। ডেকার্টের মতো তিনি সবকিছুকে সন্দেহ করতেন। ডেকার্ট যেমন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেন, তেমনি গাজালিও তাঁর নিজ মনের মুখ্য ধারণাবলি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতেন। আল গাজালি প্রতিটি ধর্মবিশ্বাস ও মতবাদকে জানার জন্য প্রস্তুত থাকলেও তিনি কোন মতবাদকেই গ্রহণ করেন নি। বরং প্রত্যেকটি সম্বন্ধই ছিল তাঁর সংশয় ও সন্দেহ। একটি বিষয়ে তিনি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সত্যকে জানার সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে অন্যের প্রাধিকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য।
ইমাম আল গাজালি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শন ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাই ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত। এ সমস্ত তত্ত্ব কখনই সুনিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে না। তৎকালীন সময়ে কিছু ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদের আবির্ভাব ঘটেছিল তারা যেসব বিষয় বিচার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেন তা ছিল ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক। ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের অর্থ বুঝতে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই গাজালির মতে, দার্শনিকরা যে সকল বিষয় আলোচনা করেছেন তা খুবই ত্রুটিপূর্ণ।
আল গাজালির মতে, জ্ঞানবিজ্ঞানের যে সকল শাখা কোন উৎস থেকে জ্ঞান অর্জন করে তাকে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। সে উৎস যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহলে তা থেকে যে জ্ঞান পাওয়া যাবে তাও ত্রুটিপূর্ণ হবে। তাঁর মতে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন প্রাধিকার বা অন্ধবিশ্বাস নয়, বরং প্রয়োজন হচ্ছে সংস্কার ও প্রাধিকারমুক্ত স্বাধীন চিন্তা। এ স্বাধীন চিন্তাই সব কিছুকেই সন্দেহ করতে বাধ্য। তবে এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সুনিশ্চিত সত্য লাভ করা।
আল গাজালির সংশয়বাদের প্রতি ছিল ঐতিহাসিক ঝোঁক। দ্রব্য ও গুণ ছাড়া সকল ক্যাটেগরি বা প্রকারকে আত্মগত পরিণত করে। আশারীয় পরমাণুবাদ পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে সংশয়বাদের অবয়ব গঠন করে। এর পূর্বেও আল নাজ্জাম ও আবু আল হুদায়েল এর মুতাজিলাগণ সকল জ্ঞানের সূচনা হিসেবে সংশয়ের নীতি বা সূত্র গঠন করেছিলেন।
আল গাজালি বিচার বিশ্লেষণ না করে কোন কিছু গ্রহণ করেন নি। যুক্তিতর্কের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরম আধ্যাত্মিক সত্তার স্বরূপ আবিষ্কার করা যায় না বলে তিনি মনে করেন। অতঃপর তাঁর সময়ে প্রচলিত চিন্তা পদ্ধতি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তিনি এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, একমাত্র মরমী অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মানুষের আত্মা সরাসরি সত্যের ধারণা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। তিনি বলেন, সুফি সাধকগণ গভীর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পরম সত্যের জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম। তাঁর মতে, পরম জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রত্যাদেশ বা ওহি, প্রজ্ঞা নয়।
ডেকার্ট ও হিউমের সাথে গাজালির মতের পার্থক্য: ডেকার্টের সংশয়বাদের সাথে আল গাজালির সংশয়বাদের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। সঠিক ও সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে ডেকার্ট ইন্দ্রিয়লব্ধ ধারণাসমূহকে সন্দেহ করলেও, তিনি একটা হেতুবাক্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেই হেতুবাক্যটি হচ্ছে “আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি অস্তিত্বশীল।” সমস্ত সংশয়ের উর্ধ্বে সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল এই হেতুবাক্য নিহিত ‘চিন্তন’ বা বিচার বিশ্লেষণমূলক প্রজ্ঞা আমাদেরকে সঠিক জ্ঞান উত্তরণে সহায়তা করতে পারে। ডেকার্টের মতে, সঠিক ও সুনিশ্চিত জ্ঞান শুধু বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমেই পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, আল গাজালি এ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমে সঠিক ও সুনিশ্চিত জান লাভ সম্ভব নয়। তাঁর মতে, একমাত্র স্বজ্ঞার মাধ্যমেই সত্যের জ্ঞান লাভ করা যায়। আবার হিউমের মতবাদেও সংশয়বাদ লক্ষ্য করা যায়। হিউম দ্রব্য, আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতায় এসব জানা যায় না। তাঁর মতে, আমাদের সমস্ত জ্ঞান আসে ইন্দ্রিয়জ এবং ধারণা থেকে। তার মতে, জড়জগৎকে ইন্দ্রয়জ করে এবং দ্রব্য, আত্যা ও ঈশ্বরের জ্ঞান সম্ভব নয় বলে এ কথাই বলতে চাচ্ছেন যে, সবকিছুই সংশয়পূর্ণ। কোন জ্ঞান সুনিশ্চিত নয়। অন্যদিকে, গাজালি ভিন্ন মত পোষণ করে বলেন, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মাধ্যমে সুনিশ্চিত জ্ঞান পাওয়া যায় না। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে তিনি কখনই গ্রহণ করেন নি, বরং বর্জন করেছেন। তাঁর মতে, সত্য জ্ঞানের সন্ধান দিতে পারে একমাত্র স্বজ্ঞা।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল গাজালি একজন মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদ ও সংশয়বাদী দার্শনিক ছিলেন। ডেকার্ট এবং গাজালি উভয়ই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন। জ্ঞানের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করলেও বিশ্ব ইতিহাসে আল গাজালির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মুসলিম দর্শনে তার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।