সমকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে আলীগড় আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, তৎকালীন প্রেক্ষাপটে আলীগড় আন্দোলনের তাৎপর্য আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব মনীষী পশ্চাৎপদ মুসলমানদের অজ্ঞতা, অশিক্ষা, সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে সৈয়দ আহমদ খান অন্যতম। তিনি তৎকালীন ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের নবজাগৃতির অন্যতম পথ-নির্দেশক ছিলেন। তার পরিচালিত উত্তর ভারতের আলীগড়ভিত্তিক সংস্কার আন্দোলন ইতিহাসে আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। এটি ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতাধর্মী সম্পর্ক স্থাপনের সংস্কার আন্দোলন।

সমকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে আশীগড় আন্দোলনের প্রভাব: অধিকার বঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। নিচে আলীগড় আন্দোলনের কতিপয় প্রভাব আলোচনা করা হলো:

১. মুসলিম জাতীয়তার উন্মেষ : আলীগড় আন্দোলনই মুসলমানদের জাতীয়তার উন্মেষ ঘটিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অংশ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। মুসলমানদের পৃথক ও একক স্বাধীনতা ও স্বাধীন সত্তা লাভের পটভূমি রচনা করেছিল।

২. মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি: আলীগড় আন্দোলনের কারণে অনেক মুসলিম মনীষী সমাজে নবজাগরণের সচেষ্ট হন। এদের মৌলভী চেরাগ আলী, সৈয়দ আমীর আলী, বদরুদ্দিন তায়েবজীর নাম উল্লেখযোগ্য। সওয়ার আব্দুল লতিফের মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি, সৈয়দ আমীর আলীর সেন্ট্রাল মোহামেডান এবং বদরুদ্দিন তায়েবজীর আনজুমান-ই-ইসলাম মুসলমানদের পুনর্জাগরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

৩. রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি: আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে উদারবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আহম্মদ কতিপয় বাস্তবমুখী ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এতে ইংরেজ-মুসলিম ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয় এবং ইংরেজ- মুসলিম বৈপরিত্যের পরিবর্তে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে।

৪. সামাজিক সচেতনা সৃষ্টি : এর মধ্যেমে মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ফলে তারা ইংরেজি প্রশাসনের সহযোগিতা ও সামঞ্জস্যতা বিধানের মাধ্যমে সমাজে পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। জাশীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হয়।

৫. শিক্ষিত মধবিত্ত মুসলিম শ্রেণি সৃষ্টি: স্যার সৈয়দ আহমদ বোঝাতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানরা যতোদিন হিন্দু সম্প্রদায়ের সমক্ষক না হবে ততোদিন পর্যন্ত তাদের দুর্দশা দূর হবে না। তার প্রচেস্টার ফলে মুসলমানরা পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে আসতে সক্ষম হয়। তিনি উপমহাদেশের নগরবাসী মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তোলতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন।

৬. সহযোগিতামূলক রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন: ১৮৫৭সালের সিপাহী বিপ্লবোত্তর মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে সৈয়দ আহমদ রাজানুগত্য প্রদর্শন করেন। কারণ অধঃপতিত ও হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের সিপাহী বিদ্রোহের পর যেভাবে ইংরেজ রাজশক্তির আক্রোশ ও নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল। তাতে ভারতবর্ষে একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের বেঁচে থাকা দায় হয়ে ওঠে।

৭. সম্পর্ক উন্নয়ন ও অধিকার অর্জন: আন্দোলনের ফলেই মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে সুম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের সকল প্রকার ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটে। আলীগড় আন্দোলনের ফলে মুসলমানরা তাদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হয়।

৮. শিক্ষাবিস্তার: আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। মুসলমানরা ইংরেজ ও অন্যান্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য দর্শন প্রভৃতি অধ্যয়ন শুরু করে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানরা ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। ফলে তাদের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়।

৯. সমাজ সংস্কার: রাজ্যহারা মুসলমান জাতি ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব নিয়ে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার ও সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে সমাজে অবাঞ্ছিতভাবে বসবাস করত। আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে এসব দূর করা হয়।

১০. শিক্ষা বিস্তার: আলীগড় আন্দোলনের ফলে মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে হিন্দুদের সক্ষমতা অর্জন করে।

১১. হারানো গৌরব উদ্ধার: আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের হারানো গৌরব অর্জন করে। আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে উদারবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আহমদ কতিপয় বাস্তবমুখী ও সুদূরপ্রসারি পদক্ষেপ নেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, স্যার সৈয়দ আহমদ খান এর পরিচালনায় আলীগড়কে কেন্দ্র যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তার শিক্ষা, ভাবধারা ও অবদানে পুষ্ট ও উপমহাদেশের মুসলমানগণের জীবনধারা এক সোনালি ধারায় প্রবাহিত হয়। এটা পরবর্তীকালে স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকে অনুপ্রাণিত করে। তাই এ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এর মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের অধিকার পেতে সক্ষম হয়।