স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও তার কর্মজীবন সম্পর্কে যা জান লিখ।

অথবা, স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও তার কর্মজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

অথবা, স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও তার কর্মজীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও।

উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় মুসলমানদের পূনঃজাগরণের ইতিহাসে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নাম একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিরাজমান। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন হিন্দু সমাজ ব্রিটিশ রাজ্যের চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সর্বক্ষেত্রে সুবিধালাভ করছিল তখন মুসলমান্না ব্রিটিশ রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। সেই চরম দুর্দিনে ভারতীয় মুসলমানদের পুনরায় সঠিক দিক নির্দেশনা ও সুপথে পরিচালিত করতে স্যার সৈয়দ আহমদ আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে আসেন। তিনি আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমান সমাজে নব জাগরণের সূচনা করেছিলেন।

১. স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পরিচয়: স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সনে দিল্লির এক সয়াজ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পারিবারিক পরিবেশেই তিনি শিক্ষা লাভ করেন। আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা ছাড়াও ইসলামি ধর্মশাস্ত্রেও তিনি প্রভূত ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

২. কর্মজীবন: স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৩৯ সালে অগ্রগতি কমিশনার দফতরে ডেপুটি রিডার এর পদ লাভ করেন এবং ১৮৪১ সালে ফতেহপুরের সাব-জজ পদে উন্নতি লাভ করেন।

৩. রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি: স্যার সৈয়দ আহমদ খানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যান-ধারণা থেকে প্রাথমিক বিচারে তাকে একজন একনিষ্ট ইংরেজভুক্ত বলে মনে হতে পারে। ইংরেজ কর্তাব্যক্তিদের সুনজরে থাকার শরণে তিনি চাকরির ক্ষেত্রে ক্রমগত উন্নতি লাভ করতে থাকেন। এছাড়া সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হবার সময় অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে অনেক ইংরেজকে বিপদমুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।

৪. পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে : স্যার সৈয়দ আহমদ খান অনগ্রসর মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারকল্পে ১৮৭৫ সালে আলীগড় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিদ্যালয়টি প্রথমে মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ ও পরবর্তীতে, (১৯২০) আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রধানত মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এর দ্বার সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য উন্মুক্ত ছিল।

৫. আক্রোশ ও বিদ্বেষ নিরসন: মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের আক্রোশ ও বিদ্বেষভাব নিরসনের জন্য সৈয়দ আহমদ খান The causes of Indian Revolt নামক পুস্তিকায় বিপ্লবের কারণ তুলে ধরেন। এতে তিনি ব্যাখ্যা দেন যে, যেহেতু ভারতীয় জনপ্রতিনিধিগণকে কখনো আইন সভায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি, যে কারণে বহু দিন থেকে ভারতীয় জনমতে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। সরকারের সাফল্য ও স্থিতিশীল তার স্বার্থে ইংরেজ সরকারের উচিৎ ছিল আইন সভায় জনমতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।

৬. জাতিবাদ ও ঐতিহ্য চেতনা : জাতীবাদ ও ঐতিহ্য চেতনা সম্পর্কে সৈয়দ আহমদের সংজ্ঞায় ভারতের হিন্দু মুসলিম সমস্যা সম্পর্কে তাঁর গভীর সচেতনতার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর জাতিবাদের মূল ভিত্তি ধর্ম নয় স্বদেশ। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মসম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর ভিত্তিতে জাতি তৈরি হতে পারে না। ব্রিটিশ ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ যখন একাত্ন হয়ে এক রাষ্ট্রে বসবাস করে তখন তারা জাতিসত্তা লাভ করে। তৎকালীন ভারতে হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানেরা সবদিক থেকেই অনগ্রসর ছিল। কাজেই মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার তাগিদ তিনি গভীরভাবে অনুভব করেন।

৭. স্যার সৈয়দ আহমদ খানের উদ্দেশ্য: মুসলিম জীবনকে আবার এদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল স্যার সৈয়দ আহমদের প্রধান উদ্দেশ্য। তাতে তিনি আশাতীত ভাবে সফলকামও হয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ যে উদ্দেশ্যে আলীগড় আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। চরিত্রগত দিক দিয়ে বিচার করলে তাকে সম্ভবত ইসলামী আন্দোলন বলা যাবে না। কারণ এদেশে ইসলামকে মুক্ত করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে সমঝোতা করে যাতে ইসলাম টিকে থাকে তাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কুরআনকে যুক্তিসহ উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি কুরআনের ভাষ্য লেখেন এবং কুরআনের আদেশ নিষেধের উপর গুরুত্ব আরোপ করে হাদীসকে পেছনে ঠেলে দেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কুরআনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রচার করা। কাজেই কুরআনের যেসব আয়াতের সঙ্গে বিজ্ঞানের সত্যগুলোর বিরোধ উপস্থিত হয়েছে সেগুলোকে তিনি বর্জন করে বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতি-তাঁর অটল নিষ্ঠ্য প্রকাশ করেন।

উপসংহার: স্যার সৈয়দ আহমদ ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, নবজাগরণের পুরোধা এবং শিক্ষাবিদ। তিনি তার আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগিয়ে তোলেন। পাশ্চাত্য চিন্ত – ধারার সাথে মুসলমানদের সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষেত্রে তার অবদান অপরিসীম।