আলীগড় আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে যা জান আলোচনা কর।

অথবা, মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণে আলীগড় আন্দোলনের অবদানের বর্ণনা দাও।

উত্তর : ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব মনীষী পশ্চাৎপদ মুসলমানদের অজ্ঞতা, অশিক্ষা,সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ অন্যতম। তিনি তৎকালীন ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের নবজাগৃতির অন্যতম পথনির্দেশক ছিলেন। তাঁর পরিচালিত উত্তর ভারতের আলীগড়ভিত্তিক সংস্কার আন্দোলন ইতিহাসে আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। স্যার সৈয়দ আহমদ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা মোকাবেলা করে অধঃপতিত মুসলমানদের মর্যাদা সহকারে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বালীগড় আন্দোলন গড়ে তোলেন। এটি ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতাধর্মী সম্পর্ক স্থাপনের সংস্কার আন্দোলন। মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণে আলীগড় আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল।

আলীগড় আন্দোলনের অবদান: স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান পরিচালিত আলীগড় আন্দোলন উপমহাদেশের মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জনে উৎসাহিত করে। যা পরবর্তীতে মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুদূরপ্রসারী অবদান রাখতে সক্ষম হয়। নিম্নে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণে আলীগড় আন্দোলনের অবদান বর্ণনা করা হলো:

১. শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান: শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের উন্নতির জন্য মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজটি পরবর্তীতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এ উপমহাদেশে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সাধনের জন্য এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর অবদান রেখে চলেছে। যার সুফল আজকের মুসলমানরা প্রত্যক্ষভাবে ভোগ করছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে “The college was much more than a seat of learning, it soon became the centre of the political, cultural and literary life of the Indian Muslims.”

অর্থাৎ, এ কলেজটি জ্ঞানের অনেকগুলো শাখায় বিভক্ত ছিল। এটি ক্রমান্বয়ে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

২. আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধকরণ: ইংরেজ সরকার মুসলমানদের কোনো প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে সম্মত ছিল না বিশেষ করে তারা হিন্দুদের তুলনায় ইংরেজি ও বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে ছিল। আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে স্যার সৈয়দ আহম্মদ মুসলমানদেরকে ইংরেজ সরকারের সহযোগিতা নিয়ে এসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। এজন্য তিনি তাহজিব-উল-আখলাক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যাতে মুসলমানরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ পেতে পারে এবং পাশ্চাত্যের সাহিত্য ও বিজ্ঞান রপ্ত করতে পারে। এ আন্দোলনের পটভূমিতে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদতার কারণ স্যার সৈয়দ আহমদ খান চিহ্নিত করেন-

(ক) সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব।

(খ) নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার অভাব।

(গ) অপরাধ বা অনৈতিকতা এবং মুসলিম ধ্যান-ধারণা ও আচরণের অভাব।

(ঘ) মুসলমানদের মধ্যে কুসংস্কার।

(ঙ) সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাগত ত্রুটি।

(চ) মুসলমানদের ব্যবহার, অভ্যাস, প্রথাগত ত্রুটি।
এসব ত্রুটি অনুসন্ধান করে স্যার সৈয়দ আহমদ স্পষ্টভাবে বলেন যে, প্রচলিত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা কোনোভাবে মুসলমানদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এ আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে মুসলমানদের উন্নতির পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে ইংরেজি বইগুলো উর্দু ভাষায় রূপান্তর করে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধশালী করতে সাহায্য করেন।

৩. মুসলমানদের একতাবদ্ধকরণ : ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করে এসেছে। যাতে মুসলমানরা তাদের সমস্যাগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে সমাধা করতে পারে। এক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমেদের দু’ধরনের আহবান ছিল-

প্রথমত: মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি।

দ্বিতীয়ত: মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা যে যেখানে লেখাপড়া করুক এবং বসবাস করুক তাদের মধ্যে পরস্পর সহনশীলতার অনুভূতির জন্ম দেয়া।

৪. পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিতিকরণ: আলীগড় আন্দোলন ভারতবর্ষের মুসলিম জাতি সত্তার বিকাশে নিয়োজিত ছিল। বিশেষ করে অনুবাদ সমিতি যা পরবর্তীতে আলীগড় বিজ্ঞান সমিতি নামকরণ হয়। স্যার সৈয়দ আহমেদ সমিতিতে তাঁর বন্ধু ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের কাজ করার জন্য আহ্বান জানান এবং পশ্চিমা দেশের বই পুস্তুক উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে ভারতের মুসলমানদের কলা, বিজ্ঞান আইন ও সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি তার বিজ্ঞান সমিতিতে বলেন। আমি লক্ষ্য করি যে, আমাদের অতীত ইতিহাস অজ্ঞতার এবং এ জাতির এমন কোনো নির্দেশনা নেই যা তাদেরকে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনে সাহায্য করতে পারে। এ সমিতিতে কর্নেল গ্রাহাম উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করত এবং ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করত এবং তার সহযোগিতায় স্যার সৈয়দ আহমদ একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া কলেজে রূপান্তর হয়।

ভারতীয় মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশের স্বার্থে ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় তিনি সাপ্তাহিক আলীগড় গেজেট নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সাপ্তাহিক হলেও সপ্তাহে দু’সংখ্যা প্রকাশিত হতো। মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার ক্ষেত্রে এ পত্রিকার অবদান ছিল এবং যে সময় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সাংবিধানিক সংকট উত্তরণের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ অপরিহার্য ছিল।

৫. মুসলিম জাতিসত্তার বিকাশ: আলীগড় আন্দোলন ভারত উপমহাদেশের মুসলিম পুনর্জাগরণের সূত্রপাত ঘটায়। মুসলমানরা যেভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ ছিল তা থেকে মুক্ত জ্ঞান চর্চায় এবং তৎকালীন পাশ্চাত্য জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিতি করণে আলীগড় আন্দোলন যে অবদান রাখে তার সূত্র ধরে দুইটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রগতি সাধিত হয়।

প্রথমত: শাসক এবং শাসিতদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি দূর করে একটি বিশ্বস্ত পরিবেশ তৈরি করা “To remove distrust and achieve understanding between the rulers and the ruled (Muslims).

দ্বিতীয়ত: মুসলমানদের অধঃপতান এবং স্থবিরতা থেকে জাগ্রত করা “To arouse the muslims from downfall and stagnation” মুসলমানরা এ আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার এবং ইংরেজদের সাথে ভুল বুঝাবুঝি দূর করতে অনেকাংশে সফল হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, এ আন্দোলন মুসলমানদের উন্নয়ন ও সংগঠিত হবার এক আন্দোলন। যদিও এ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব স্যার সৈয়দ আহম্মদকে আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনের কারণে গোঁড়া মুসলিমরা তাকে কাফির হিসেবে অভিহিত করে কিন্তু শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও স্যার সৈয়দ আহম্মদ ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগ ব্যাহত হয়নি। এ আন্দোলন মুসলিম সমাজের কুসংস্কারের পরিবর্তে মুক্ত চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটায়। এজন্য এ আন্দোলন প্রসঙ্গে বলা হয়, “Aligarh Movement opened the door of modern education for Indian Muslims and brought about a new awakening among them.” অর্থাৎ আলীগড় আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য আধুনিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করে এবং তাদেরকে নতুনভাবে জাগ্রত করতে সাহায্য করে।