অথবা, ইবনে রুশদের দৃষ্টিতে আল গাজালির মতবাদসমূহ মূল্যায়ন কর।
অথবা, গাজালির মতবাদসমূহ ইবনে রুশদ কিভাবে বিশ্লেষণ করেছেন?
অথবা, ইবনে রুশদ আল গাজালির মতবাদ সম্পর্কে কী বলেন?
উত্তরঃ ভূমিকা: ইবনে রুশদ মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে পরিগণিত। ইউরোপের জনগণ তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ও এরিস্টটলের প্রখ্যাত ভাষ্যকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি ইসলামি আইনের একজন সফল ব্যাখ্যাকার হিসেবেও সুপরিচিত। ইমাম আল গাজালি দার্শনিকদের অধিকাংশ তত্ত্বকে ভ্রান্ত বলে মনে করেন। আর ইবনে রুশদ গাজালির এ ধরনের প্রতিবাদ সমর্থন করেন নি। তিনি দার্শনিকদের মতবাদসমূহকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
ইবনে রুশদ কর্তৃক গাজালির মতবাদসমূহ মূল্যায়ন: ইমাম আল গাজালি এবং ইবনে রুশদ উভয়ই মুসলিম পাশ্চাত্য দর্শনের উল্লেখযোগ্য দার্শনিক ছিলেন। ইমাম আল গাজালি মুসলিম দার্শনিকদের মতবাদসমূহকে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রতিবাদ করেন। আর ইবনে রুশদ গাজালির এসব মতবাদ সমর্থন করেন নি। ইবনে রুশদ তার বিখ্যাত গ্রন্থ “Tahafut al Tahafut” গ্রন্থে ইমাম আল গাজালির মতবাদসমূহ সমালোচনা করেন। নিম্নে ইবনে রুশদ যেভাবে গাজালির মতবাদ মূল্যায়ন করেন তা তুলে ধরা হলো:
১. হিংসাত্মক মনোভাব: ইবনে রুশদ বলেন যে, গাজালি দার্শনিকদের অধিকাংশ মতবাদকে ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করেন। তিনি তাদেরকে ইসলাম বিদ্বেষী এমনকি কাফের বলেও মন্তব্য করেন। ইবনে রুশদ গাজালির মতবাদ পর্যালোচনা করে বলেন যে, যেভাবে গাজালি দার্শনিকদের মতবাদসমূহ খণ্ডন করেন তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিংসাত্মক।
২. দার্শনিকদের মতবাদ অনুধাবন না করা: ইবনে রুশদের মতে, গাজালি দার্শনিকদের মতবাদসমূহ না বুঝেই অনেক ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছেন। কোনকিছুকে সমালোচনা বা পর্যালোচনা করতে হলে ঐ বিষয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। ইবনে রুশদ বলেন, ইমাম আল গাজালি, ইবনে সিনা, আল-ফারাবি প্রমুখ চিন্তাবিদ যথার্থভাবে দার্শনিকদের মতবাদসমূহ বুঝতে পারেন নি।
৩. বিভ্রান্তি সৃষ্টি: ইবনে রুশদ ইমাম আল গাজালির সমালোচনায় বলেন, তিনি তড়িঘড়ি করে প্রচুর পরিমাণ গ্রন্থ লিখে জ্ঞানের রাজ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। কেননা তার অনেক গ্রন্থই পর্যাপ্ত বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক বা পাণ্ডিত্যের ফসল নয়। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই আবেগ ও অন্ধবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মতবাদ প্রদান করেন।
৪. পর্যাপ্ত পাণ্ডিত্য ছিল না: গাজালি যেভাবে দার্শনিক মতবাদসমূহ সমালোচনা করেছেন তা ইবনে রুশদ তীব্র প্রতিবাদ করেন। ইবনে রুশদের মতে, দার্শনিকদের মতবাদসমূহ বুঝার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা গাজালির ছিল না। তিনি বলেন যে, আল ফারাবি, ইবনে সিনা প্রমুখ দার্শনিকদের মতবাদসমূহ অথবা প্লেটো, এরিস্টটল প্রভৃতি গ্রিক দার্শনিকদের মতবাদ বুঝার মতো পর্যাপ্ত পাণ্ডিত্য গাজালির ছিল না।
৫. কূটতর্ক প্রসূত যুক্তি: ইবনে রুশদের মতে, ইমাম আল গাজালি যেভাবে একতরফাভাবে দার্শনিকদের যুক্তি খণ্ডন করেছেন তা সঠিক হয় নি। কেননা দার্শনিকদের মতবাদ খণ্ডনে গাজালির অধিকাংশ যুক্তি কূটতর্ক প্রসূত। তিনি পুরোনো কালের সোফিস্ট দার্শনিকদের মতো তর্কের খাতিরে তর্ক করেছেন। তবে জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোচনায় এরকম তর্কের খাতিরে তর্ক করা যুক্তিযুক্ত হয় নি।
৬. স্ববিরোধিতা: ইবনে রুশদ বলেন যে, দার্শনিকদের মতবাদসমূহ গাজালি পর্যালোচনা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধিতায় উপনীত হয়েছেন। যেমন গাজালির প্রথম দিকের রচনা ‘মাকাসিদুল ফালাসিফা’ মূলত গ্রিক দর্শনের অনুকরণে প্রণীত। আবার তার বিখ্যাত ‘তাহাফুতুল ফালাসিফা’ গ্রন্থে তিনি গ্রিক দর্শনের চরম বিরোধিতা করেন। তাছাড়া গাজালি ফালাসিফা সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের কাফের বলে উল্লেখ করেন। সুতরাং রুশদের মতে, এভাবে মতবাদের সমালোচনা করা স্ববিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৭. উদারহীনতা: ইবনে রুশদ গাজালিকে উদারহীন বলে অভিহিত করেছেন। কেননা ধর্মতাত্ত্বিক অনেক বিষয় গাজালি যেভাবে গোঁড়া ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন অথবা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন তা ইবনে রুশদ মেনে নেন নি। তার মতে, গাজালির এ ক্ষেত্রে আরো উদার হওয়া উচিত ছিল।
মূল্যায়ন: মুসলিম দর্শনের চরম সংকটের মুহূর্তে ইমাম আল গাজালি এবং ইবনে রুশদের আবির্ভাব ঘটে। তারা উভয়ই তাদের স্থান-কালের বাস্তবতা দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত এবং একই সাথে সত্যের সাধক ছিলেন। ইসলামের মূল আদর্শকে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন দল অভ্যন্তরীণভাবে বিতর্কিত করে তুলেছিল। মানবিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা চিরন্তন সত্য। কেবল প্রত্যাদেশ ছাড়া কারো পক্ষে চূড়ান্ত সত্য লাভ করা সম্ভব নয় বলে গাজালি স্বীকার করেন। ফলে গাজালির যেভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অভিযোগকারী বলে ইবনে রুশদ চিহ্নিত করেছেন তা যথার্থ নয়। কারণ গাজালিও দর্শনের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইবনে রুশদ ছিলেন অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ সংস্কারমুক্ত ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন উঁচু মানের চিন্তাবিদ। কেননা তিনি কোন মতবাদ কট্টরভাবে বর্জন না করে অনেকটা সহমর্মিতার সাথে পর্যালোচনা করার জন্য পরামর্শ দেন। গাজালির বিরুদ্ধে তার কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না। তিনি শুধু মনে করেন, গাজালির আরো উদার হওয়া দরকার ছিল এবং দার্শনিকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনার পূর্বে তাদের মতবাদগুলোকে ভালোভাবে যাচাই করা উচিত ছিল। সুতরাং গাজালির মতবাদসমূহকে তিনি যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন তা একেবারে অমূলক নয়।