দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে ইমাম আল গাজালি ও দার্শনিকদের যুক্তিগুলো ইবনে রুশদ কিভাবে আলোচনা করেন?

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে ইবনে রুশদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে ইমাম আল গাজালি ও দার্শনিকদের যুক্তিগুলো ইবনে রুশদ কিভাবে বিশ্লেষণ করেন?

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ বিশদভাবে বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ইবনে রুশদ ছিলেন মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তার পুরো নাম আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে রুশদ। তিনি শৈশবেই শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। কর্দোভার বিশ্বাবিদ্যালয়ে তার উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত হয়। তিনি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ইবনে রুশদ তার বিভিন্ন আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে দৈহিক পুনরুত্থান সম্পর্কে আলোচনা অন্যতম। তিনি তার বিখ্যাত “Tahafut al Tahafut” গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

দৈহিক পুনরুত্থান সম্বন্ধে দার্শনিকদের যুক্তি: দার্শনিকগণ দৈহিক পুনরুত্থান স্বীকার করেন না। তাদের মতে, পুনরুত্থান দিবসে মানুষ নতুন করে দেহ ধারণ করে পুনরুত্থিত হবে না, বরং মানুষের আত্মা যা অমর তাই ঐ দিবসে পুরস্কার ও শাস্তি গ্রহণ করবে। নিম্নে পুনরুত্থান সম্পর্কে দার্শনিকদের যুক্তি তুলে ধরা হলো:

প্রথম যুক্তি: দার্শনিকগণ তাদের প্রথম যুক্তিতে বলেন যে, দৈহিক পুনরুত্থান যদি হতে হয় তাহলে তিনটি বিকল্পের মাধ্যমে হতে হবে। বিকল্প তিনটি হচ্ছে:

ক. দেহ মৃত্তিকা রূপে বিদ্যমান থাকা। পরে তা আবার নতুনভাবে আকার গ্রহণ করা।

খ. দেহের অংশগুলোকে একত্রিত করে তাতে আত্মার পুনর্গমন করা।

গ. আত্মা যে কোন একটি দেহে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় যুক্তি: দার্শনিকগণ দেখাতে চান যে কোন সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি, পর্যায় বা ক্রম আছে। যেভাবে পুনরুত্থানের কথা স্বীকার করা হয় তাতে এসবের কোন উল্লেখ নেই, ফলে পুনরুত্থান কার্যত অসম্ভব।

তৃতীয় যুক্তি: আল্লাহর কর্ম পদ্ধতির মধ্যে কোন ব্যতিক্রম নেই। যদি দৈহিক পুনরুত্থান একবার ঘটে তাহলে এটা একটি অপরিবর্তনীয় নিয়মে পরিণত হবে।

ইমাম গাজালি কর্তৃক দার্শনিক মতবাদ খঞ্চন: ইমাম আল গাজালি দার্শনিকদের এ যুক্তিকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, যারা দৈহিক পুনরুত্থান স্বীকার করেন না তারা মুসলমান নয় বরং কাফের। নিম্নে দার্শনিকদের বিরুদ্ধে তার যুক্তিসমূহ তুলে ধরা হলো:

প্রথমত, আল্লাহ পুনরুত্থান ঘটাবেন বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি পছন্দ মতোই সবকিছু সৃষ্টি করেন। পুনরুত্থান যে কোন অবস্থায় হলেই চলে। কারণ মানুষের দৈহিক আকৃতি কিছুটা পরিবর্তন হলেও তাতে ঐ ব্যক্তির অভিন্নতা নউ ২য় না।

দ্বিতীয়ত, ইমাম আল গাজালি বিশ্বাত্মা বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তার ধারণা, মানুষের আত্মা ব্যক্তিগতভাবে অমর। তার মতে, দার্শনিকদের যুক্তি জগতের অনাদিত্ব সংক্রান্ত সমস্যার দ্বারা আক্রান্ত। জগৎ যে অনাদি নয় তা পূর্বেই প্রমাণ করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, গাজালির মতে, আত্মা সমান করে ঐ সংখ্যায় মানুষ সৃষ্টি করতে হলে সেখানে কোন সমস্যা হবে না। আল্লাহ তার কাজের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। ফলে আল্লাহ মাটি থেকে মানুষ তৈরি করতে পারবেন না বলে দার্শনিকরা যে যুক্তি দিয়েছেন তা যথাযথ নয়।

চতুর্থত, গাজালির মতে, কার্যকলাপের ক্ষেত্রে আল্লাহর নিয়ম থাকতে পারে তবে নিয়মের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায় না। কেননা আল্লাহ কার্যকারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে পারেন।

দৈহিক পুনরুত্থান সম্বন্ধে ইবনে রুদের মতবাদ : ইমাম আল গাজালি মুসলিম অমুসলিম সব দার্শনিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তারা কেউ দৈহিক পুনরুত্থানে বিশ্বাস করেন না। ইবনে রুশদ বলেন, তার এ অভিযোগ সঠিক নয়। নিম্নে পুনরুত্থান সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ তুলে ধরা হলো:

প্রথমত, দৈহিক পুনরুত্থান প্রমাণ করতে গিয়ে ইমাম আল গাজালি কুরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “এটা এমন যে, কোন চোখ তা দেখে নি, কোন কান তা শোনে নি এমনকি কোন মানুষের মনে এমন ধারণা প্রবেশ করে নি।” হাদিসে মুহাম্মদ (স) বলেছেন যে, পরকালীন জীবনে বেহেশত এমন হবে যা কোন চোখ দেখে নি, কোন কান শোনে নি আবার আমাদের ভাবনারও বাইরে। সুতরাং এটা প্রমাণিত হয় যে, পরকালীন জীবন ইহকালীন জীবন থেকে ভিন্ন ধরনের হবে।

দ্বিতীয়ত, কোন কোন দার্শনিক ইবনে রুশদের মতের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন যে, ইবনে রুশদের মতে, মানবাত্মার ব্যক্তিগত অমরত্বের ও মরণোত্তর পুনরুত্থানের কোন সুযোগ নেই, কেননা মৃত্যুর পরে ব্যক্তি আত্মা সার্বিক আত্মার সঙ্গে একাকার হতে গিয়ে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে। এর প্রতিবাদে ইবনে রুশদ বলেন, মৃত্যুর পরে আত্মার ব্যক্তিগত অস্তিত্বের কোন সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত: ইবনে রুশদ মরণোত্তর জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন। কেননা তিনি নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, মরণোত্তর জীবনের পক্ষে বিভিন্ন ধর্মে ঐকমত্য রয়েছে। বহু দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিধ এ বিষয়ের পক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মরণোত্তর জীবন নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশ নেই।

চতুর্থত, ইবনে রুশদের মতে, যা পুনরুত্থিত হয় তা মৃত মানুষটির একটি Image মাত্র। কিছু কিছু ধর্মতাত্ত্বিকের
ভাষায় আত্মা হচ্ছে একটি আপতিক বিষয়। তিনি মনে করেন যে, যে বিষয়টি নিতান্তই আপতিক সেখানে কোন নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব নয়। যদি দেহের সাথে আত্মা আবারও পরকালে ঐ দেহের সাথেই আবশ্যিকভাবে মিলিত হবে এর নিশ্চয়তা নেই।

পঞ্চমত, দেহের পুনরুত্থান সম্পর্কে ইবনে রুশদ বলেন যে, মৃত্যুর পরে মানুষ যে দেহ ধারণ করবে, তা অবিকল পার্থিব জীবনের মতো হবে একথা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা কঠিন। কেননা একবার যা তিরোহিত হয়, তা অবিকল পূর্বাবস্থায় যে ফিরে আসবে তা প্রমাণ করা মুশকিল।

মূল্যায়ন: মুসলিম দার্শনিকগণ, ইমাম গাজালি এবং ইবনে রুশদের মতবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা সবাই দেহের পুনরুত্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। পুনরুত্থান কোন দৈহিক ব্যাপার নয়, বরং এটি একটি আত্মিক বিষয় বলে ফালাসিফা সম্প্রদায়ের অধিকাংশ দার্শনিক মনে করতেন। দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ গাজালি যেভাবে প্রতিবাদ করেছেন তাতে করে যুক্তি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস এক হয়ে গেছে। মূলত ধর্মভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির উপরই তিনি জোর দিয়েছেন। গাজালি এবং ফালাসিফা দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ যেভাবে ইবনে রুশদ পর্যালোচনা করেছেন তাতে করে মনে হয়, তিনি মূলত দার্শনিকদের মতবাদকেই পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। দার্শনিকদের ভিন্ন আঙ্গিকে সমর্থন করতে গিয়ে তিনি যেভাবে গাজালির যুক্তিসমূহ খণ্ডন করতে চেয়েছেন বা গাজালির মতের বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য পেশ করেছেন তা সর্বাংশে যথার্থ যুক্তিপূর্ণ নয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ইবনে রুশদ দৈহিক পুনরুত্থান সর্ম্পকে যে আলোচনা করেছেন তা মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে খোদ দৈহিক পুনরুত্থানের বিষয়েও যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। দৈহিক পুনরুত্থান বিষয়ে গাজালি এবং দার্শনিকদের মধ্যে মতের পার্থক্য লক্ষ্য করা গেলেও কোন মুসলমানের দৈহিক পুনরুত্থান ব্যাপারে অন্তত সন্দেহ থাকার কথা নয়। সুতরাং দৈহিক পুনরুত্থান বিষয়ে ইবনে রুশদের অবদান অস্বীকার করা যায় না।