
অথবা, অখণ্ড স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
উত্তরা। ভূমিকা: সুপ্রাচীনকাল থেকে আধুনিক পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে যে, বাংলা একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদির দিক থেকে ভারত এর অন্যান্য অঞ্চল থেকে পৃথক সত্তা ধারণকারী। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের ক্রান্তি লগ্নে, এ ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড রাখার জন্য একটি আন্দোলন হয় যা অখণ্ড বাংলা আন্দোন নামে আমাদের কাছে সুপরিচিত।
পটভূমি: ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে, কিভাবে স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে উঠে এবং এর কারণ কি ছিল সে সম্পর্কে পণ্ডিত ও গবেষকগণ বিভিন্ন মত দিয়েছেন। নিচে তা দেওয়া হলো:
১. ঐতিহাসিক কারণ: সুদীর্ঘকাল থেকে ভারতে বাংলা অঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ৮ম শতকে পাল বংশের শুরু থেকে ৫০০ বছর বাংলা এক স্বাধীন ভূখণ্ড ছিল। বাংলা স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে প্রায় (১৩৪২-১৫৩৮) টিকে ছিল। সুলতানি আমলে বাঙালি জাতীয়তায় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হয়। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভৌগোলিক রাজনৈতিক ঐক্য এবং ভাষা ও কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বতন্ত্র অবস্থা তৈরি হয়। মুঘল ও ব্রিটিশদের সময় জাতীয়তার অগ্রগতিতে বাধাপ্রাপ্ত হলেও পরবর্তীতে আবার ঐক্যের প্রয়াস পায়। অবশেষে দেশ ভাগের আগ মুহূর্তে স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২. বাংলা বিভক্তি প্রতিরোধ: অধিকাংশ পণ্ডিত এর ধারণা এটি ছিল বাংলা বিভক্তি প্রতিরোধের উপায়। বাংলার
প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়াদী বাংলাকে অবিভক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, “বাংলাদেশ বাঙালিদের এবং এটি অবিভাজ্য।” যে মুসলমানরা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিল তারা বাংলা বিভক্তির বিরুদ্ধে ছিল। আবার যে সকল হিন্দু নেতারা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল তারা ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের কথা বলে। অথচ বাংলার মুসলমান নেতারা বাংলা অখণ্ডতার পক্ষে ছিল।
৩. হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়াস বাঙালি হিন্দুরা ভারতীয় জাতীয়তা ও অখণ্ড ভারতের আদর্শে বিশ্বাসী থাকলেও তারা বাংলার স্বতন্ত্র সত্তার পক্ষে ছিল। বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদের ইসুতে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছিল তা পরবর্তীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বার্থে আবার সৌহার্দ্য ফিরে পায়।
৪. বাঙালি মুসলমান ও অবাঙালি মুসলমানদের দ্বন্দ্ব: ১৯৪০ সালের পর অবাঙালি মুসলমান ও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যেমন- এ. কে. ফজলুল হকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণ ছিল অবাঙালি মুসলিম নেতাদের দ্বারা বাংলার প্রতি অবহেলা। তাই ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম বুঝতে পারেন যে অবাঙালি মুসলমানদের নেতৃত্বে বাংলার স্বতন্ত্রতা ও স্বার্থ রক্ষা পাবে না।
বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি: এসব কারণে বাংলাকে বিভক্ত হওয়ার থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯৪৭ সালের ২০ মে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস এটি আলোচনা করেন। এতে মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী, ফজলুর রহমান, আবুল হাশিম এবং এ. এম. মালিক এবং কংগ্রেসের শরৎবসু, কিরণ সঙ্কর রায়, সত্যরঞ্জন বখসী উপস্থিত ছিলেন। এ সভায় অখণ্ড বাংলা গঠনের জন্য একটি প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তা হলো:
ক. বাংলা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে।
খ. বাংলার জন্য নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে এবং আইনসভায় হিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যানুপাতে আসন
থাকবে।
গ. সামরিক, পুলিশ ও অন্যান্য চাকরিতে বাঙালিদের প্রাধান্য।
ঘ. সংবিধান পরিষদ গঠন করা হবে মুসলমান ও হিন্দুদের নির্দিষ্ট সংখ্যানুপাতে।
প্রস্তাব প্রকল্প এরপর অখণ্ড বিপক্ষে জনমত তৈরি হতে থাকে। এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়।
মুসলিম লীগ: এ প্রস্তাবের আগে অখণ্ড বাংলার পক্ষে থাকলেও পরবর্তীতে প্রকাশ্যে তীব্র বিরোধিতা করে। আকরাম
খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দিন এর তীব্র সমালোচনা করে।
কংগ্রেস: অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবে প্রথম থেকে কংগ্রেসের হাইকমান্ডার জওহরলাল নেহেরু ও সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল এর তীব্র বিরোধিতা করে প্যাটেল বলেন, বাংলার অমুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাংলাকে অবশ্যই বিভক্ত করতে হবে।
ব্রিটিশ সরকার: বাংলার গভর্নর ও ভারত সচিব অখণ্ড বাংলার পক্ষে ছিল। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন বলেছিলেন যে, সোহরাওয়ার্দী এ প্রস্তাব ত্যাগ করেন। কিন্তু এ সকল বিষয়ের পরও এ মহান উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
ব্যর্থতার কারণ:
১. এ প্রস্তাব উদ্যোক্তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল।
২. বাংলার লীগ ও বাংলার কংগ্রেসদের মধ্যে মতানৈক্য।
৩. অনেক বিলম্বে এ প্রস্তাব পেশ করা হয় যখন বাংলা প্রায় বিভক্তির পথে।
৪. ১৯৪০ এর পর থেকে বিভিন্ন সময় এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে মুসলমান ও হিন্দুদের সম্পর্কের অবনতি হয়।
৫. কমিউনিস্ট পার্টি অখণ্ড বাংলার পক্ষে থাকলেও তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে ব্যর্থ হয়।
৬. সবচেয়ে বড় কারণ হলো ভারতীয় কংগ্রেস এর হাইকমান্ডদের বিরোধিতা যা এ মহৎ প্রয়াসকে সফল হতে বাধা প্রদান করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলা অঞ্চল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। পরবর্তীতে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যকার সৌহার্দ্য বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে অবনতি হয়। এ কারণে ১৯৪৭ সালের অখও বাংলার পক্ষে জটিলতা সৃষ্টি হয় যার দরুন ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট বাংলা বিভক্ত হয়।