অথবা, আত্মা সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আত্মা একটি আধ্যাত্মিক পদার্থ এ সম্পর্কে ইবনে রুশদ কিভাবে গাজালির
যুক্তিগুলো ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করেন।
অথবা, আত্মা সম্পর্কে ইবনে রুশদের মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, আত্মা সম্পর্কে ইবনে রুশদ কী মতবাদ দেন, বর্ণনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ইউরোপে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাধিক প্রভাবশালী দার্শনিক হলেন ইবনে রুশদ। বিচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার ক্ষেত্রে নির্ভীক চিত্ততার জন্য তিনি দর্শন জগতে শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছেন। পাশ্চাত্য জগতে ইবনে রুশদের প্রভাব এতই অধিক ছিল যে তার মতবাদ অ্যাভেরোইজম (Averroism) নামে চিহ্নিত হয়েছে। আত্মা সম্পর্কে ইবনে সিনাসহ প্রায় সকল মুসলিম দার্শনিকই তাদের নিজস্ব মতবাদ উপস্থাপন করেছেন। ইবনে রুশদ মুসলিম দার্শনিক ও গাজালির যুক্তিসমূহ পর্যালোচনা করে বলেন যে, দার্শনিকদের মতবাদকে উপেক্ষা করা যায় না।
গাজালির মতবাদ ইবনে রুশদ কর্তৃক খণ্ডন: ইমাম আল গাজালি বলেন, দার্শনিকগণ মানুষের প্রবৃত্তিকে জ্ঞানের অংশ ও কল্পনাশক্তি এ দু’ভাগে ভাগ করেছেন। ইবনে রুশদ প্রথমে ইমাম আল গাজালির দার্শনিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের যুক্তি খণ্ডন না করে প্রতিবাদ করেন যে, যদি দার্শনিক বলতে গাজালি ফালাসিফা সম্প্রদায় বা জগতের সকল দার্শনিকদের কথা বলেন, তাহলে তিনি ঠিক করেন নি। ইবনে রুশদের মতে, বুদ্ধিকে কল্পনাশক্তি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করা সম্ভব বা কল্পনার মধ্যে বৌদ্ধিক কোনকিছু বিদ্যমান থাকে না। নিম্নে ইবনে রুশদ যেভাবে গাজালির মতবাদ খণ্ডন করেন তা আলোচনা করা হলো:
১. অবিভাজ্য বিষয়: দার্শনিকদের সম্পর্কে ইমাম আল গাজালি বলেছেন যে, তারা এমন যুক্তি দিয়েছেন যা জ্ঞানের স্থান হিসেবে আত্মাকে তারা অবিভাজ্য বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যা যুক্তিযুক্ত নয়। তার মতে, বস্তুত আরোপিত জ্ঞান বিভাজ্য হবে আর অবস্তুতে আরোপিত বিষয় অবিভাজ্য হবে এর কোন সত্যতা নেই। ইবনে রুশদ গাজালির এ অভিযোগটিকে দুই ভাগে ভাগ করেন। যথা:
প্রথমত, কোন বিশেষ দেহের কোন বিশেষ অংশে যদি কোন জ্ঞান আশ্রয় করে থাকে তাহলে ঐ দেহের প্রত্যেক * অংশের সত্তার সাথে তা সমভাবে আরোপিত হবে।
দ্বিতীয়ত, কোন গুণকে যখন কোন বিশেষ দেহ বা বিশেষ অঙ্গের উপর আরোপ করা হয় তখন এ দেহ বা ঐ অদের সামগ্রিক অংশের উপর তা আরোপিত হয় এবং ঐ দেহ বা অঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করলে ঐ গুণটি তার উপর আরোপ করা যায় না। যেমন- চোখের উপর যখন দৃষ্টিশক্তি গুণটি আরোপ করা হয় তখন তা সামগ্রিকভাবে করা হয়ে থাকে। চোখকে খণ্ড খণ্ড করে ফেললে ঐ খণ্ডিত অংশের উপর দৃষ্টিশক্তি গুণটি প্রয়োগ হয় না।
২. বিচ্ছিন্ন কিছু নয়: গাজালির মতে, আত্মার মধ্যে যে আনীয় অংশ রয়েছে দার্শনিকগণ তাকে দেহের সকল অঙ্গের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করেছেন। এ যুক্তিকে গাজালি ভ্রান্ত বলে বর্ণনা করেছেন। কেননা আত্মার মস্তিষ্কে অবস্থিত অংশ লেখার ইচ্ছা করে আর হাতে অবস্থিত অংশ যদি লিখতে না চায় তাহলে বিভ্রাট দেখা দিবে। ইবনে রুশদ গাজালির বিরোধিতায় বলেন তার এ অভিযোগ যুক্তিযুক্ত নয়। তার মতে, প্রথম যুক্তির আলোচনা থেকে এটা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
৩. দেহ ব্যতীত জ্ঞানের অস্তিত্ব অসম্ভব: দার্শনিকদের মতে, মানুষের জ্ঞান কোন বিশেষ অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত নয়। যেহেতু জ্ঞান একটি অনির্দির বিমূর্ত বিষয়, সেহেতু একে কোন বিশেষ অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত করা যায় না। সুতরাং জানের কর্তা বা আত্মাকে অবশ্যই দেহের সাথে যুক্ত না করে তাকে আধ্যাত্মিক বলে স্বীকার করতে হবে। দার্শনিকদের এ যুক্তিকে গাজালি নিবুদ্ধিতার নিদর্শন বলে চিহ্নিত করেছেন। ইবনে রুশদ গাজালির এ যুক্তি মেনে নেন। নি। তার মতে, দার্শনিকগণ বলেছেন, আমাদের আন শরীরের নির্দিষ্ট কোন অঙ্গের সাথে জড়িত নয়। এটা প্রমাণিত সত্য, ইবনে রুশদ বলেন যে, দেহের কোন স্থানে জ্ঞান নেই কিন্তু দেহ ছাড়াও আনের কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে। না। একথা কল্পনা করা যায় না।
৪. পরস্পর বিরোধী চিন্তা সম্ভব নয়: দার্শনিকদের মতে, যদি জ্ঞান দৈহিক কোন অঙ্গ যেমন- হৃদয়, মস্তিষ্ক ইত্যাদির সাথেই সম্পর্কিত বা ইত্যাদির মধ্যেই অবস্থান করতো তবে এর বিপরীত মূর্খতাকেও অনুরূপ অন্য কোন অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত করতে হবে। কারণ একই অঙ্গে বিপরীত গুণ ধারণ করা যায় না। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জ্ঞান হৃদয় বা মস্তিষ্ক এমন কোন বিশেষ দৈহিক অঙ্গের উপর নির্ভরশীল নয়। দার্শনিকদের এ ধরনের যুক্তির বিরোধিতা করে গাজালি বলেন যে, বিভিন্ন বিপরীত গুণ বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা সংঘটিত হওয়ার দরকার নেই। ইবনে রুশদ বলেন, দার্শনিকদের নামে গাজালির মূল প্রতিবাদ হচ্ছে তিনি জ্ঞানকে এমনভাবে দেহের মধ্যে অবস্থানকারী বলতে চান না, যেভাবে বর্ণ ও অন্যান্য গুণাবলির বস্তুর সাথে বিদ্যমান থাকে।
৫. তাত্ত্বিক বা দ্বান্দ্বিক যুক্তি: দার্শনিকদের মতে, যদি জ্ঞান দৈহিক অঙ্গের দ্বারা জ্ঞাত হতো তাহলে এটা নিজেকে জানতে সক্ষম হতো না। কারণ যা অন্যকে জানে তা নিজেকে জানে না। এর উত্তরে গাজালি বলেন যে, এটি একটু ব্যতিক্রম যে, জ্ঞান অপরকে এবং একইভাবে নিজেকে জানে। ব্যতিক্রম কখনো নিয়ম হয় না। সুতরাং দার্শনিকরা বিষয়টি আবশ্যিকভাবে প্রমাণ করতে পারে নি। গাজালির প্রতিবাদে ইবনে রুশদ বলেন যে, এ ধরনের যুক্তি শুধু তাত্ত্বিক বা দ্বান্দ্বিকভাবে অনুমিত যুক্তি নয়, বরং এর বাস্তব উদাহরণও রয়েছে।
৬. আত্মার অবস্থান অঙ্গে নয়: দার্শনিকগণ বলেছেন যে, আত্মা হৃদয় ও মস্তিষ্ক সবকিছুই জানে, সুতরাং এগুলোর মধ্যে তথা দৈহিক কৌন অঙ্গের মধ্যে আত্মা নেই। দার্শনিকদের মতবাদের সমালোচনায় গাজালি বলেন, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি অনুভব আমাদের হৃদ্যয় থেকেই হয়। সুতরাং হৃদয়ে আত্মা নেই একথা বলা যায় না। এর ব্যাখ্যায় রুশদ দেখাতে চান যে, দার্শনিকগণ কোন অঙ্গে আত্মার অবস্থান তা বলেন নি। তাছাড়া দার্শনিকগণ এমন ধারণাও করেন না যে, দেহ থেকে আত্মার উৎপত্তি হয়েছে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমরা আত্মার যথার্থ প্রকৃতি নিয়ে যতই যুক্তির অবতারণা করি না কেন, এ বিষয়ে আমাদের সুনিশ্চিত জ্ঞান আছে বলে দাবি করার মতো কোন যুক্তি নেই। কেননা মানুষের আত্মা একটি আধ্যাত্মিক পদার্থ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। ইবনে রুশদ যেভাবে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ ও গাজালির যুক্তিসমূহের সমন্বয়ের ভিত্তিতে নিজস্ব যে মত দিয়েছেন তা প্রশংসার দাবিদার।