ইবনে রুশদ কিভাবে আত্মার অবিনশ্বরতা না অমরত্বের পক্ষে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ ও গাজালির যুক্তিসমূহকে মূল্যায়ন করেছেন?

অথবা, আত্মার অবিনশ্বরতা বা আদরতের পক্ষে ইবনে রুশদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা কর।

অথবা, ইবনে রুশদ কিভাবে আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্বের পক্ষে দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ ও গাজালির যুক্তিসমূহকে বিশ্লেষণ করেছেন?

অথবা, আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্বের পক্ষে ইবনে রুশদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: আত্মার অবিনশ্বরতা প্রসঙ্গে সকল মুসলিম দার্শনিকই একমত। তবে দার্শনিক যুক্তির মাধ্যমে যখন তাঁরা আত্যার অবিনশ্বরতা প্রমাণ করতে গিয়েছেন তখন তাঁদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মতানৈক্য। ফালাসিফা সম্প্রদায়ের মুসলিম দার্শনিকগণ অর্থাৎ আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা প্রমুখ মুসলিম দার্শনিকগণ আত্মার অবিনশ্বরতা বা অমরত্ব প্রমাণ করতে যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন গাজালি সেগুলোকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেছেন। গাজালির এসব অভিযোগকে ইবনে রুশদ পর্যালোচনা করেন।

আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয়ে ইবনে রুশদের দৃষ্টিভঙ্গি: ইবনে রুশদ Tahafut al Tahafut’ নামক গ্রন্থে গাজালির যুক্তিসমূহ খণ্ডন করার প্রয়াস নেন। দার্শনিকদের বিরুদ্ধে ইমাম আল-গাজালি যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন ইবনে রুশদ তার উল্লেখ করেই তার প্রতিবাদ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি দার্শনিকদের যুক্তিগুলোও মাঝে মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

গাজালির মতে, দার্শনিকরা আত্মাকে দেহান্তর মনে করেছেন। তাঁরা মনে করেন আত্মা দেহের বহিরাগত কিছু। যদি আত্মা বহিরাগত একটা কিছু হয়, তাহলে দেহ ধ্বংসের সাথে আত্মাকেও ধ্বংসের বিষয়টি অনুমোদন করা যায় না। গাজালি মনে করেন ধর্মতাত্ত্বিকরা এটা স্বীকার করেন না।

ইবনে রুশদের মতে, আল-গাজালির এ অভিযোগ সর্বোতভাবে গ্রহণ করা যায় না। কারণ যেভাবে তিনি গোটা দার্শনিকদের একদলভুক্ত করেছেন অর্থাৎ উল্লিখিত যুক্তি সকল দার্শনিকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন তা সঙ্গত নয়। কারণ
এটা ইবনে সিনার অভিমত। সকল দার্শনিকের মতবাদ নয়। গাজালি ইবনে সিনার মতবাদকেই সকল দার্শনিকের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।

ইবনে রুশদের মতে, দার্শনিকরা এর বিপক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেন যে, দু’টি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে সংযুক্ততার সম্পর্ক বা ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও এটা আবশ্যিক নয় যে, একটি মাংসের সাথে অন্যটি গাসেপ্রাপ্ত হবে। তিমি উদাহরণ হিসেবে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক চুম্বক ও লোহার মধ্যকার সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। যেখানে একটির গালে অনিবার্যভাবে অন্যটিকে ধ্বংস করে না। ইবনে রুশদই একমাত্র এ আবশ্যিকতার কথা প্রকাশ করেছেন। কারণ সংখ্যাগত ভিন্নতায় তিনি আত্মাকে বিশিষ্ট করেছেন। সকল দার্শনিকই এটা স্বীকার করেন যে, এক ধরনের স্বর্গীয় রশ্মি আছে, যা সকল সম্ভাব্য সত্তার মূলভাগে বর্তমান রয়েছে। প্রাণী এবং উদ্ভিদ সবকিছু এ স্বর্গীয় রশ্মি বা শক্তিই উৎপন্ন করে। এ সম্ভাব্যতাকে কিছু কিছু দার্শনিক ঐশি প্রাকৃতিক সম্ভাব্যতা বলে থাকেন। কিন্তু গ্যালেন প্রমুখ দার্শনিক একে আকারিক শক্তি অথবা ডেমিয়াজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, জাগতিক বিষয়টি এমন যে, জগত সৃষ্টির একজন জ্ঞানী নির্মাতা আছেন, যিনি এসব সৃষ্টি করেছেন এবং এটি এমন একটি সৃষ্টি প্রক্রিয়া, যা শরীরবিদ্যার আওতার বাইরে। তবে সে নির্মাতার স্থান এবং সারসতা এত সুউচ্চ যে, তাকে বুঝা মানবিক বুদ্ধির পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। ইবনে রুশদের ধারণা, প্লেটো এর মাধ্যমেই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, আত্মা দেহ থেকে পৃথক সত্তা। তাঁর মতে, যদি আত্মার অস্তিত্বের জন্য দেহ শর্ত হয়, তাহলে আত্মা দেহকে সৃষ্টি করতে বা গঠন করতে পারবে না।

একথা কখনও দার্শনিকরা অস্বীকার করেন না যে, এমন এক প্রকার উপাদানসূচক আত্মা আছে যা প্রাণী, উদ্ভিদ এবং সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক বস্তু সৃষ্টি করে। আত্মা স্বর্গীয় দেহ এবং সংবেদনশীল দেহের মধ্যবর্তী একটা কিছু। দেহ ধ্বংসের পরে আত্মা তাদের আধ্যাত্মিক উপাদানে ফিরে আসে। এ আধ্যাত্মিক উপাদান হল বিশ্বআত্মা। ইবনে, রুশদ মনে করেন, এ অবস্থায় আত্মা নিজের স্বকীয়তা হারায়।

দার্শনিকদের এ মতের প্রতিবাদ করে গাজালি বলেন, দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেই আত্মার ব্যক্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান থাকে। দেহ ধ্বংসের পরে তার আর কোন স্বাতন্ত্র্য থাকে না। গাজালি বলেন, এটা স্বীকার করে নিলে ব্যক্তি আত্মার অস্তিত্ব সম্পূর্ণ দেহ নির্ভর হয়ে পড়ে।

ইবনে রুশদের মতে, এ অভিমত মূলত ইবনে সিনার মতবাদ। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি ইবনে সিনাকে সমর্থন করেন। তিনি গাজালির মতের বিপক্ষে বলেন যে, দেহের মৃত্যুর পরে আত্মা অতি সূক্ষ্ম অপ্রত্যক্ষণযোগ্য অংশ ধারণ করে টিকে থাকে। এ অপ্রত্যক্ষণীয় অংশকে ইবনে রুশদ এক ধরনের জৈব উষ্ণতা বলে চিহ্নিত করেন।

ইবনে রুশদ মনে করেন যে, প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে কেউ সাধারণত আত্মার অমরত্ব অবিশ্বাস করেন নি। শুধু তাঁরা আত্মাকে দেহের সাথে করে ভাবতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আত্মার স্বতন্ত্র অস্তিত্বে ইবনে রুশদ বিশ্বাস করেন না। তাঁর ধারণা আত্মা ব্যক্তির দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে বিশ্ব আত্মার সাথেই মিশে যায়। ফলে মৃত্যুহীন আত্মা একটি বিশেষ আত্মা বা ব্যক্তি নয় এটি সর্বজনীন আত্মার সাথে একাকার।

পর্যালোচনা: ইবনে রুশদ অনেকটা ফালাসিফা সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের মতোই আত্মার অবিনশ্বরতা বা আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেসব বিষয়ে তিনি স্বকীয় কিছু দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন এবং ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন তাঁর ভিত্তি তেমন শক্ত নয়। বস্তুত ইবনে রুশদ আত্মার অমরত্বের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন তা অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির। আত্মার ব্যক্তিগত অমরত্বে ইবনে রুশদ বিশ্বাস করেন না। যদি আত্মা বিশ্ব আত্মার সাথে মিশে যায়, তবে শাস্তি বিধান করলে সকল আত্মার উপর তা সংঘটিত হবে। লক্ষণীয় যে, ইবনে রুশদের এ আত্মাতত্ত্ব আল্লাহর ন্যায়বিচারের বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে পারে না।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ইবনে রুশদ একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মাকে আধ্যাত্মিক বলেছেন। আত্মা দেহের মৃত্যুতে ফাংস হয় না, ইবনে রুশদ এটা প্রমাণ করতে গিয়ে চুম্বক ও লোহার উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন চুম্বক ও লোহার মধ্যে সম্পর্ক আছে তবে এদের একটি ধ্বংসের সাথে অন্যটির ধ্বংসের আবশ্যিকতা নেই। আত্মারও তেমনি দেহের সাথে সম্পর্ক থাকলেও দেহের ধ্বংসের সাথে আত্মা ধ্বংস হয় না। সুতরাং মুসলিম দর্শনে ইবনে রুশদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।