অথবা, ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্ক বিষয়ে ইবনে রুশদের মতামত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ইবনে রুশদ কিভাবে ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয় সাধন করেন আলোচনা কর।
অথবা, ইবনে রুশদের মতে ধর্মের সাথে দর্শনের সম্পর্ক বর্ণনা কর।
অথবা, ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্ক বিষয়ে ইবনে রুশদের মতামত বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: ভূমিকা: পাশ্চাত্যের মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী। ইবনে রুশদের পুরো নাম আবুল ওলিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ। প্রাচ্য আপেক্ষা মধ্যযুগের ইউরোপেও তাঁর দর্শন সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। মূলত তিনিই কুসংস্কারের প্রভাব থেকে ইউরোপকে নুতন জীবনের সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি মুক্ত চিন্তার এক অপূর্ব ক্ষমতা অর্জন করেছেন। ল্যাটিন ভাষায় ইবনে রুশদ আভেররোজ (Averross) নামে পরিচিত।
ধর্ম ও দর্শনের সমন্বয় সম্পর্কে ইবনে রুশদ: ইবনে রুশদ এরিস্টটলকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, দর্শনের সঠিক ও সামগ্রিক সত্য এরিস্টটলে নিহিত। এ সত্য আবিষ্কার ও উপলব্ধি করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। দার্শনিক আলকিন্দি থেকে শুরু করে ইবনে রুশদ পর্যন্ত মুসলিম দার্শনিকগণ একটা নির্দিষ্ট দিকে তাদের চিন্তাধারাকে নিবদ্ধ রাখে। তারা এরিস্টটল এর দর্শনে সমন্বয়সাধন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ইবনে রুশদের দ্বারা বিস্তারিত আলোচিত ফলশ্রুতিতে এ সমন্বয় প্রতিষ্ঠা তাঁর দর্শনে এসে পরিণতি প্রাপ্ত হয়।
আলকিন্দি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্ম ও দর্শন পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। আলকিন্দির ধর্ম ও দর্শন প্রত্যাদেশ ও প্রজ্ঞার মধ্যে সমন্বয়সাধনের প্রয়াস পান। তাছাড়া আল ফারাবী ও অন্যান্য মুসলিম দার্শনিক প্রত্যাদেশ ও প্রজ্ঞার সমন্বয়-সাধনের চেষ্টা করেন।
ইবনে রুশদ তাঁর ‘তাহফাতুত তাহফুত’ নামক গ্রন্থে ইমাম আল গাজালির মতকে খণ্ডন করেন। তিনি প্রত্যাদেশ ও প্রজ্ঞার সমন্বয়সাধন করেন এবং তাঁর স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন দর্শন ধর্মের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্নতো নয়ই বরং ধর্ম কর্তৃত নির্দেশিত অনুমোদিত। কুরআনে আল্লাহর সত্যানুসন্ধানের জন্য মানুষকে আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু সব মানুষের বুদ্ধি ও শক্তি এক নয়। জীবনের সব সতা বুঝার ক্ষমতা সকল মানুষের নেই। কাজেই একমাত্র অশিক্ষিত এবং মানসিক দিক থেকে দুর্বল ব্যক্তিরাই স্বাধীন চিন্তা করতে ভয় পায়। জ্ঞানের দিক থেকে অপূর্ণ বলেই তারা ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে বিরোধ খুঁজে পান। কিন্তু ইবনে রুশদ বলেন, “খোদার নিকট থেকে অর্পিত প্রত্যাদেশ, কাজেই ধর্ম সত্য, আর দর্শনও সত্য, কেননা তা মানুষের বুদ্ধি বা প্রজ্ঞালব্ধ।” কাজেই ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
ইবনে রুশদের মতে, ধর্মের এমন একটা নিজস্ব সত্যতা এবং উপযোগিতা রয়েছে, যা জনগণের মধ্যে নৈতিক শিক্ষণ বিস্তার এবং পূর্ণভাব সৃষ্টির ব্যাপারে সবচেয়ে সহজ ও নিরপেক্ষ উপায়। দার্শনিকদের মতে, জনগণের কল্যাণের জন্য ধর্ম আবশ্যিক। তিনি সাধারণ মানুষের জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। ধর্মের বাণীসমূহের দু’রকম অর্থ রয়েছে। যথা: ১ আক্ষরিক বা শাব্দিক অর্থ ও ২. রূপক অর্থ।
শাব্দিক অর্থ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, কিন্তু রূপক অর্থ কেবল চিন্তাশীল বিজ্ঞ ব্যক্তিবণই বুঝতে পারে। এ রূপক অর্থে কুরআনের বাণীর সঙ্গে দার্শনিক সত্যের সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। তবে এ দার্শনিক অর্থ সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা সাধারণ মানুষ কুরআনের গতীর মর্মার্থ অনুধাবনে উপযুক্ত নয়। কারণ তাতে মনকে বিভ্রান্ত করে তুলবে।
দার্শনিক আলোচনা এড়িয়ে চলার জন্য ইবনে রাজা নির্জন ও একাকী জীবনযাপনের যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ইবনে রুশদ সে বিষয়ে একমত নয়। তাঁর মতে, সংসার ও সমাজ ত্যাগ করা উচিত নয়, তবে দর্শন চর্চা কেবল বিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের সামনে দর্শন আলোচনা করা অনুচিত। কারণ এতে তাদের ধর্মবিশ্বাস কলুষিত হয়।
ইবনে রুশদ ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে যে সমন্বয়সাধনের প্রয়াস পান তা আনবিদ্যা সম্পর্কীয়। তাই তাঁর মতে, আন তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা:
১. অলংকারিক জ্ঞান, ২. যুক্তিসিদ্ধ জান ও ৩. প্রতিপাদক জ্ঞান আবার তিন শ্রেণীর জ্ঞানের অধিকারই সমাজের মানুষকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করে।
১. সাধারণ লোক, ২. ধর্মতত্ত্ববিদ ও ৩. দার্শনিক।
ইবনে রুশদের মতে, অলংকারিক জান সাধারণ লোকের জন্য উপযোগী, ধর্মতত্ত্ববিদদের জন্য চাই যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞান এবং দার্শনিকগণ প্রতিপাদক জ্ঞানের উপযুক্ত ধারক। জ্ঞানের ও মানুষের এ শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী তিনি কুরআনের তিন ধরনের ব্যাখ্যা নির্দেশ করেছেন। সাধারণ লোক কুরআনের অলংকারিক অর্থ গ্রহণ করে, ধর্মতত্ত্ববিদ কুরআনের যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যায় তৃপ্ত এবং দার্শনিক জ্ঞানের প্রতিপাদক ব্যাখ্যার প্রয়াসী।
ইবনে রুশদের মতে, ধর্ম ও দর্শন পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্ম শুধু দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ধর্ম দর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনুমোদন করে। মহাগ্রন্থ কুরআনের মাধ্যমে মানুষকে নৈসর্গিক বিষয়সমূহ সম্পর্কে চিন্তা করার জন্য বার বার তাগিদ দেন। কাজেই কুরআনের সাথে দর্শনের কোন বিরোধ নেই।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও ইবনে রুশদের কিছুটা ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়, তথাপি ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সমন্বয়সাধন কাজ তার দ্বারা সমাধা হয়েছিল একথা অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া যষ্ঠ দশ শতাব্দীতে ইবনে রুশদের দর্শন ইতালির সরকারি দর্শনে পরিণত হয়েছিল। চার শতাব্দী ধরে এ মনীষীই ইউরোপের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে এবং ইতালির রেনেসাঁর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল।