অথবা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগের ভূমিকা ও কার্যাবলী আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে মুসলমান সমাজ ভারতের মূল জাতীয় প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এ সময় মুসলমান সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেনি। এছাড়া এ সময়ে কোনো বিজ্ঞ নেতারও আবির্ভাব হয়নি। এছাড়াও ব্রিটিশ বৈষম্যমূলক নীতির কারণে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় পারস্পরিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে এবং এ দু’সম্প্রদায় পৃথকভাবে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একুশ বছর পর ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে এ দলের দাবির পেক্ষিতে ভারত বিভাগ হয় এবং জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান।
মুসলিম লীগের ভূমিকা: মুসলমানদের জন্য পৃথক বাসস্থান গড়ার লক্ষ্যে মুসলিম লীগ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগ যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে নিম্নে সেগুলো উপস্থাপন করা হলো:
১. মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা: ব্রিটিশ ভারতের আইনসভা ও প্রশাসনে মুসলমানদের খুবই প্রতুল প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর বড় লাটকে দেয়া এক সংবর্ধনায় মুসলমানরা যাতে আইনসভা ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায় সে উদ্দেশ্যে পৃথক নির্বাচনের দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে। পরবর্তীতে ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনে ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। যা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে মাইল ফলক হিসেবে কাজ করে।
২. মুসলমানদের জন্য দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ সরকার ১৯০৯ সালে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু মুসলমানরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। মুসলমানদের মুখপাত্র হিসেবে মুসলিম লীগ ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। তাই বলা যায় মুসলমানদের জন্য দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম লীগের এ দায়িত্বশীল ভূমিকা একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনকে ত্বরান্বিত করে।
৩. লক্ষ্ণৌ চুক্তি: ১৯০৯ সালের সংস্কার আইনের পর ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তি ভারতবর্ষের মুসলমানদের দাবি দাওয়া পূরণে এবং বিভিন্ন সুবিধা প্রদানে একান্ত সহায়তা করে। মুসলিম লীগ মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক দল, তা এ চুক্তির মাধ্যমে স্বীকৃতিলাভ করে। এ চুক্তি দ্বারা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। এছাড়া এ চুক্তির ফলে মুসলিম লীগ মুসলমানদের সামগ্রিকভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে কংগ্রেসের সাথে এক লাইনে দাঁড়ায়।
৪. নেহেরু রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান: ১৯২৮ সালের ২৮ নভেম্বর কলকাতায় সর্বদলীয় সভা আহ্বান করা হয়। নেহরু রিপোটের – সুপারিশসমূহ বিবেচনা করার জন্য। এ সময় মুসলিম লীগ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে ২৩ সদস্যবিশিষ্ট একদল প্রতিনিধি প্রেরণ করে এ সভার ৪টি সংশোধনী প্রস্তাব করে মুসলিম লীগ, কিন্তু তাদের দাবি সভায় অগ্রাহ্য হয়। ফলে নেহরু রিপোর্ট মুসলিম লীগ প্রত্যাখ্যান করে।
৫. সাইমন কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান: সাইমন কমিশনের রিপোর্ট ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু এতে মুসলমানদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া উপেক্ষিত হয়। ফলে মুসলিম লীগ কংগ্রেসের ন্যায় উক্ত রিপোর্টে সন্তুষ্ট হতে পারেনি, তাই মুসলিম লীগ এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে।
৬. ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিরোধিতা: ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা হলে মুসলিম লীগ এর তীব্র বিরোধিতা করে। কেননা মুসলিম লীগ বুঝতে পারে মুসলমানরা যদি এ আইন মেনে নিয়ে সংঘবদ্ধ হয় তাহলে তাদের দাবি দাওয়া কখনোই বাস্তবায়িত হবে না এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা সর্বদাই অবহেলিত ও উপেক্ষিত থাকবে। মুসলিম লীগের এ সকল সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে পথকে ত্বরান্বিত করে।
৭. লাহোর প্রস্তাব: ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক এ অধিবেশনে দ্বি-জাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত।
৮. ১৯৪৬ সালের নির্বাচন: ভারতের রাজনৈতিক অচল অবস্থা নিরসনের জন্য ১৯৪৫ সালের ব্রিটেনের লেবার পাটি আন্ত রিক ইচ্ছা প্রকাশ করে। এরই প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের নির্বাচন। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং নির্বাচনে তারা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
৯. মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ: মুসলিম লীগের দাবি দাওয়া গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান রাষ্ট্র দাবিকে স্বীকৃতি দান করে। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন লিখিত ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনের বহু তর্ক-বির্তকের পর মুসলিম লীগ মাউন্ট ব্যাটেনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতে মুসলিমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও দাবি দাওয়া প্রকাশে সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবিরাম সংগ্রাম ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এ সংগঠন মুসলমানদের দাবির প্রতি ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করে। মুসলিম লীগের এ অবিরাম সংগ্রাম ৪০ বছর পর তার ফসল স্বরূপ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।