লক্ষ্মৌ চক্তির পটভূমি আলোচনা কর।

অথবা, লক্ষ্মৌ চুক্তির পটভূমি ও ধারা বিশ্লেষণ কর।

অথবা, লক্ষ্ণৌ চক্তির পটভূমি এবং ইহার প্রধান ধারাগুলো বর্ণনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই ভারতীয়রা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করেন। এক পর্যায়ে ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় কংগ্রেস তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখতে ব্যর্থ – হয়। তখন আলাদা জাতি হিসেবে মুসলমানরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ গঠন করে। এক পর্যায়ে দুটি সংগঠন সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এক পর্যায়ে দেখা গেল তাদের কারোই মূল দাবি দাওয়া পূরণ হচ্ছে না। তাই ১৯১৬ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ অধিকার আদায়ের সংকল্পে লক্ষ্মৌ শহরে একটি চুক্তি সম্পাদন করে যা লক্ষ্ণৌচুক্তি নামে খ্যাত।

এ লক্ষ্মৌ চুক্তির পটভূমি: ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে স্বাক্ষরিত লক্ষ্ণৌচুক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটি ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। নিচে ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তির পটভূমি আলোচনা করা হলো:

প্রথমত: ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতবাসীর সব দাবি দাওয়া পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের স্বীকৃতি দেয়া হয়। মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন এর অধিকার প্রদান করা হয়। তথাপিও এ সংস্কার আইন মুসলমানদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সঙ্গত কারণেই মুসলমানদের মুখপাত্র হিসেবে মুসলিম লীগ ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষাকল্পে ব্রিটিশ সরকারের উপর আরও অধিক পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।

দ্বিতীয়ত: ১৯১১ সালে ভারতে স্বদেশী, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে বিব্রত ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করলে ব্রিটিশ সরকারে প্রতি মুসলমানদের অনুগত্যমূলক মনোভাবের অবসান ঘটে। ব্রিটিশ সরকারকে বিশ্বাস ঘাতক আখ্যায় আখ্যায়িত করে।

তৃতীয়ত: ১৯১২-১৩ সালে সংঘটিত বলকান যুদ্ধকে মুসলমানরা ইসলামের তরবারি তুরস্কের প্রতি খ্রিস্টান শক্তির ষড়যন্ত্র বলে ধরে নেয়। বলকান যুদ্ধের ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের ব্যবচ্ছেদ হলে ব্রিটেনের নীরবতায় ভারতের মুসলমানরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। এ সময় মুসলিম রাজনীতিতে দুজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদের আবির্ভাব ঘটে। তারা হলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আল-হিলাল এবং মোহাম্মদ আলীর কমরেড পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারের নীতিকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার ও মুসলমানদের সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়।

চতুর্থত: মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের কাছে আলীগড় কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার অনুরোধ করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার দাবি প্রত্যাখ্যান করলে মুসলমানদের মনে হতাশা বৃদ্ধি পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় মুসলিম লীগের উদারপন্থি নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ভারতে সাধারণ জাতীয়তা বিকাশে এবং রাজনৈতিক সংস্কারের সমর্থনে জনমতকে জাগ্রত করার মাধ্যমে দেশ সেবাকল্পে হিন্দু মুসলমানদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

পঞ্চমত: ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দে মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ভারতীয় জাতীয়তা দলের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন সাধন করেন। মুসলিম লীগের নতুন গঠনতন্ত্রে দলের লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয় যে; নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রশাসনে ক্রমাগত সংস্কার সাধন, জাতীয় ঐক্য জোরদার করা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা হচ্ছে মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

ষষ্ঠত: ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এ যুদ্দকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনীতির ধারার কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়। এ যুদ্ধের সময়কালে মুসলমান ও হিন্দু নেতৃবর্গ নিজেদের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষাকল্পে নিজেদের মধ্যে এক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে থাকেন। জিন্নাহ মুসলিম লীগের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের শত্রুদের প্ররোচনায় আতঙ্কিত হয়ে হিন্দুদের সাথে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকবেন না, কারণ স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্তির জন্য এ সহযোগিতা অপরিহার্য।

সপ্তমত: কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে এক যোগসূত্র স্থাপনের ব্যাপারে কংগ্রেস নেতা লোকমান্য তিলক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কারণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপর গুরুত্বারোপ জরুরি ছিল। ১৯১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে মুসলিম লীগের অষ্টম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। একই সময় কংগ্রেস ও বোম্বাইতে অধিবেশনে মিলিত হয়। এ সময় মুসলিম লীগের সভাপতি আজহার উল হক তাঁদের অভিভাষণে ব্রিটিশ নীতির কঠোর সমালোচনা করেন এবং হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও সহযোগিতার উপর জোর দিয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করেন। এ সময় আব্দুর রসুল, ফজলুল হক ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ হিন্দু মুসলিম মৈত্রীর জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা চালিয়ে যান। অতঃপর ১৯১৬ সালের ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর লক্ষ্ণৌতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে কমিটি কর্তৃক যুক্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা উপস্থাপিত ও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত ও সাংবিধানিক পরিকল্পনাটিই ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌচুক্তি নামে অভিহিত।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৬ সালে যে, লক্ষ্মৌ চুক্তি সম্পাদিত হয় তাকে ভারত ইতিহাসের একটি যুগান্ত কারী অধ্যায় বলা যায়। কেননা এ চুক্তির ফলে ভারতে হিন্দু মুসলমানদের ঐক্যের এক মইল ফলক তৈরি হয়, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এ দু’দল একত্রি হয়। ফলে লক্ষ্মৌ চুক্তির সকল দাবি ব্রিটিশ সরকার মানতে বাধ্য হয়।