অথবা, ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর: ভূমিকা: ভারত উপমহাদেশের সাংবিধানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মুসলমান ও হিন্দু নেতৃবৃন্দ নিজেদের পারস্পরিক স্বার্থরক্ষাকল্পে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯১৫ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বোম্বাইতে এক অধিবেশনে মিলিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯১৬ সালে বোম্বাই, অধিবেশনের সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি। এই চুক্তিই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক উদ্দীপনা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সক্রিয় করে তোলে।
লক্ষ্মৌ চুক্তির পরিচয় : প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা থাকলেও ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এ সময় ভারতে রাজনৈতিক চেতনার বৃদ্ধি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও দায়িত্ব সরকারের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ১৯১১ সালের বঙ্গবঙ্গ রদ, ১৯১৪ সালে বলকান যুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব ভারতীয় মুসলমানদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। অপরদিকে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে কংগ্রেস আন্দোলন শুরু করে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলমানদের অসন্তোষ এ দুটি সম্প্রদায়ের সংঘবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রেক্ষিতে ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌতে জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ যৌথভাবে এক সভায় মিলিত হয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা লক্ষ্মৌ চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তি সম্পাদনে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভূমিকা ছিল অনন্য।
লক্ষ্মৌ চুক্তির বৈশিষ্ট্য: নিচে লক্ষ্মৌ চুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি: লক্ষ্মৌ চুক্তি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমঝোতায় উপনীত হয় মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সাথে একত্রে ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠান দাবি করবে-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মুসলমানদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ: কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত আসনের এক-তৃতীয়াংশ মুসলমানরা লাভ করনে বলে লক্ষ্মৌ চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।
৩. পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা: প্রাদেশিক আইন পরিষদে মুসলমানরা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা জাতীয় কংগ্রেস স্বীকার করে।
৪. প্রদেশে মুসলমানদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ: যে সংখ্যাগুরু সে প্রদেশে অনুপাতের কম আসন লাভ করবে। প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সে প্রদেশে তারা সংখ্যার অনুপাত অপেক্ষা অধিক আসন লাভ করবে এবং যে প্রদেশে তারা
৫. সম্প্রদায়গত আইন প্রণয়নে ব্যবস্থা নির্ধারণ: কোনো আইন পরিষদে কোনো সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের বিরোধিতার মুখে সে সম্পদায়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো আইন প্রণীত হবে না।
৬. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ক্ষমতা হ্রাস: যুদ্ধ ঘোষণা, শান্তি এবং চুক্তি সম্পাদনসহ ভারতের সামরিক নীতি, পারস্পরিক নীতি এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে ভারত সরকারের পরিচালনা ক্ষমতায় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা থাকবে না।
৭. ভারত সচিবের সম্পর্ক নির্ধারণ: ডোমিনিয়ন সরকারসমূহের সাথে ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশ মন্ত্রীর যে সম্পর্ক, ভারত সরকারের সাথে ভারত সচিবের সম্পর্ক হতে হবে অনুরূপ।
৮. প্রাদেশিক পরিষদকে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা: লক্ষ্মৌ চুক্তির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে প্রাদেশিক স্তরে পরিষদগুলোকে ঢেলে সাজাবার ব্যবস্থা করা হয়। পরিষদগুলোর এক পঞ্চমাংশ সদস্য হবেন মনোনীত এবং চার পঞ্চমাংশ সদস্য হবেন নির্বাচিত। বৃহৎ প্রদেশে সদস্য সংখ্যা ১২৫ জনের কম হবে না। ছোট প্রদেশে এর সংখ্যা হবে ৫০-৭৫ এর মধ্যে। মনোনীত সদস্য ব্যতীত বাকি সব সদস্যই জনগণের ঐক্য ভোটে – নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা এবং ভোটারদের সংখ্যা যথাসম্ভব বৃদ্ধি করা লক্ষ্মৌ চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।
৯. হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা: এ চুক্তির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো হিন্দু-মুসলিম প্রতিষ্ঠা। এ ঐক্য সাধন প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও জাতিতে বিভক্ত। ভারতবর্ষকে এক নতুন জাতিসত্তায় বিকশিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
লক্ষ্মৌ চুক্তির ফলাফল: ভারতের ইতিহাসে লক্ষ্মৌ চুক্তি একটি রুেত্বপূর্ণ দলিল। নিচে লক্ষ্মৌ চুক্তির ফলাফল উল্লেখ করা হলো:
১. হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি: ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তির ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তি রচিত হয়। এর ফলেই হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ সরকারের সম্মুখে যুক্তভাবে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি পেশ করতে সক্ষম হয়।
২. মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনাধিকার : এ চুক্তির ফলে কংগ্রেস ও মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনাধিকার মেনে নেয়। স্যার রেজিনান্ড কুপল্যান্ড ও প্রসঙ্গে বলে, “দুটি প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনের এ চুক্তিকে ব্রিটিশ ভারতে এ পর্যন্ত বিকশিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ প্রকাশ বলা যেতে পারে।”
৩. মুসলিম লীগকে মুসলামনদের দল হিসেবে স্বীকৃতি: ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তির ফলে মুসলিম লীগ মুসলমানদের প্রতিনিবিত্বমূলক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
৪. মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি: যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেসব প্রদেশে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করা হয়।
৫. আইন পরিষদে বিল পাসের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা: যে কোনো আইন পরিষদে মুসলমান সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশ সদস্য কোনো বিলের ব্যাপারে আপত্তি জানালে সে বিল আর পাস না হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ চুক্তির ফলে আইন পরিষদে বিল পাসের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. বাংলা ও পাঞ্জাবে হিন্দুদের সুবিধা বৃদ্ধি: ভারতীয় হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কংগ্রেসের সুবিধা ছিল যে, দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও তারা বিশেষ সুবিধা লাভ করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্মৌ চুক্তির মাধ্যমে উত্থাপিত দায়িত্বশীল স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিই মুসলমানদেরকে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ সরকারের মুখোমুখি উপস্থাপিত করে। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ দলীয় সংগঠনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে দলের মূল উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করে। বলাবাহুল্য, লক্ষ্মৌ চুক্তির মাধ্যমেই সর্বপ্রথম মুসলমানগণ কংগ্রেসের নিকট থেকে তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্বের স্বীকৃতি লাভ করে।