অথবা, ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে লক্ষ্মৌ চুক্তির ফলাফল বর্ণনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই ভারতীয়রা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে। এক পর্যায়ে ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় কংগ্রেস তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন আলাদা জাতি হিসেবে মুসলমানরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ গঠন করে। এক পর্যায়ে দেখা গেল তাদের কারো মূল দাবি-দাওয়া পূরণ হচ্ছে না। তাই ১৯১৬ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ অধিকার আদায়ের সংকল্পে লক্ষ্মৌ শহরে একটি চুক্তি সম্পাদন করে যা লক্ষ্ণৌচুক্তি নামে খ্যাত। এ চুক্তি সম্পর্কে সাইমও মন্তব্য করেন, ভবিষ্যৎ ভারতীয় সংবিধানের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রথমবারের মতো এবং শুধু এবারের জন্যই ঐক্যমত হয়েছিল।
১৯১৯ সালের আইনে লক্ষ্মৌ চুক্তির সাংবিধানিক দাবিসমূহ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছিল: লক্ষ্মৌ চুক্তির ধারাসমূহ মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথভাবে উত্থাপিত ভবিষ্যৎ সাংবিধানিক রূপরেখা। পরবর্তীতে প্রণীত ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে লক্ষ্মৌ চুক্তির সাংবিধানিক দাবিসমূহ কতটুকু পূরণ হয়েছিল তা উভয় চুক্তি ও আইনের তুলনামূলক আলোচনা থেকে বোঝা যায়।
নিম্নে তুলনামূলক আলোচনা উত্থাপন করা হলো:
১. দায়িত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠা: ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তিতে ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা এবং দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবি করা হয়। কিন্তু ১৯১৯ সালের ভারতশাসন আইনে প্রদেশসমূহে আংশিক দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার পদক্ষেপ নেয়া হলেও স্বায়ত্তশাসনের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অবশ্য গভর্নরদের অসহযোগিতা ক্ষমতা, প্রভাব ও হস্তক্ষেপের ফলে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাও সফল হয়নি।
২. সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব: বিভিন্ন প্রদেশে সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয় লক্ষ্মৌ চুক্তিতে। এতে আরো বলা হয়, যে সকল প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানে তারা সংখ্যানুপাতিক হারে বেশি আসন লাভ করবে। কিন্তু ১৯১৯ সালের ভারতশাসন আইনে তা পুরোপুরি মানা হয়নি।
৩. কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য বৃদ্ধি: ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তির মাধ্যমে গৃহীত হয় যে কেন্দ্রীয় আইনসভার এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম প্রতিনিধি হবে। কিন্তু ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও তা লক্ষ্মৌ, চুক্তির দাবি অনুযায়ী করা হয়নি। তবে এ আইনে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হয়।
৪. প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচন: ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে প্রাদেশিক আইন সভার ৪/৫ অংশ সদস্য নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রহণ করার কথা বলা হয়, কিন্তু ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে লক্ষ্মৌ চুক্তির দাবি অনুযায়ী সদস্য গ্রহণ না করে ৭০% সদস্য পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রহণ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
৫. গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা : লক্ষ্মৌ চুক্তিতে গভর্নর জেনারেলের হ্রাস সহ তাঁর শাসন পরিষদের অর্ধেক সদস্য ভারতীয়দের মধ্য থেকে নিযুক্ত করার দাবি করা হয়, কিন্তু ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে তা করা হয়নি। তবে এ কথা বলা হয় যে, গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদে ৭ জনের মধ্যে ৩ জন ভারতীয় সদস্য নেয়া হবে।
৬. দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে : লক্ষ্মৌ চুক্তিতে প্রাদেশিক শাসনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়।
৭. বিভিন্ন বিষয় অগ্রাহ্য: ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তির দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগনীতি পরিবর্তন ও ভারত সচিবের ভারতীয় কাউন্সিলের বিলুপ্তি। কিন্তু দেখা যায় ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের আইনে এসকল বিষয়সমূহে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। উল্লিখিত আলোচনা হতে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের যে ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করেছিল তাতে ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তির কিছু দাবি পূরণ করলেও মূল দাবিগুলো ছিল অনেকাংশে উপেক্ষিত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক বিকাশ ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এ চুক্তির ফলে ভারতীয় হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতিতে ব্রিটিশ সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন প্রনয়নে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে পড়ে। যদিও এ ভারত শাসন আইনে লক্ষ্ণৌচুক্তির কিছু দাবি মেনে নেয়া হয়েছিল তথাপি লক্ষ্মৌ চুক্তির প্রধান দাবি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে ভারতবাসীর প্রাণের দাবি সায়ত্ত্বশাসন অপূর্ণই থেকে যায়। তথাপিও এ আইন ভারতীয়দের তাদের পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণে ব্যাপক সহায়তা করেছিল।