রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে বৈসাদৃশ্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যকার পার্থক্য বর্ণনা কর।

অথবা, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।

অথবা, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান নির্ণয় কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। এর বিষয়বস্তুগত, প্রকৃতিগত, পরিধিগত ও উৎসগত কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হলো।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্যসমূহ: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:

১. বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: ইতিহাসের আলোচ্য বিষয় যথেষ্ট ব্যাপক ও বিস্তৃত। রাজনৈতিক জীবনের বিবরণ ছাড়াও ইতিহাসে ভাষা, সাহিত্য, ললিতকলা; আচার, ধর্ম, এককথায় সমাজজীবনের সর্বতোমুখী বিবর্তনের ঘটনাবলি সংরক্ষিত থাকে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সমস্যাবলি এবং রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিবর্তনের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলোকেই বেছে নেয়।

২. প্রকৃতিগত পার্থক্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের আলোচনার প্রকৃতি ও পদ্ধতি পৃথক ধরনের। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতি প্রধানত দর্শনমূলক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান আদর্শ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ন্যায়নীতি, উচিত অনুচিত ও নাগরিক অধিকার প্রভৃতি মূল্যবোধ সম্পর্কিত আলোচনা স্থান পায়। অন্যদিকে, ইতিহাসের আলোচনা পদ্ধতি বর্ণনামূলক। নৈতিকতা ও মূল্যমানের বিচার বিশ্লেষণ সাধারণভাবেই ইতিহাসের এখতিয়ারভুক্ত নয়।

৩. পরিধিগত পার্থক্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর পুরোটাই ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন- রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সংক্রান্ত মতবাদসমূহের অনেকগুলো কল্পনাপ্রসূত। দার্শনিক তত্ত্বের উপর এগুলো প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত সূত্রগুলো ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়।

৪. উৎসগত পার্থক্য: ইতিহাসকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উৎসের একমাত্র ভিত্তি বলা হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য ইতিহাস ছাড়াও আরও অনেক বিষয় থেকে উপাদান ও দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে থাকেন। এক্ষেত্রে অর্থনীতি, পরিসংখ্যান ও মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বহু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল থাকেন। তাই ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একমাত্র উৎস নয়।

৫. ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে: ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। একজন ইতিহাসবিদের ন্যায় নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সবসময় রাজনৈতিক তথ্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সবসময় ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেন না। কিন্তু ইতিহাসবিদ একটি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেন।

৬. রাজনৈতিক ঘটনার পার্থক্য: বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য মতে, সকল রাজনৈতিক ঘটনা ঐতিহাসিক নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতিসহ অন্যান্য মতবাদে কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, প্লেটোর রাজনৈতিক তত্ত্বসমূহের কথা বলা যায়। তাই দেখা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্ব রয়েছে যা ইতিহাসভিত্তিক নয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এ সম্পর্ক একদিনে তৈরি হয় নি। এটি মূলত ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। পারস্পরিক সহযোগিতার উপর উভয়েরই সাফল্য ও সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস পরস্পর পৃথক হয়ে গেলে উভয়েই অসম্পূর্ণ ও অর্থহীন হয়ে পড়বে।