রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হওয়ার কারণসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা দিনের পর দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে কেন? বর্ণনা কর।

অথবা, বর্তমানে কি কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে? আলোচনা কর।

অথবা, সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারিত হওয়ার কারণ বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে যে পুঁজির একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে কোন সমাজ বা রাষ্ট্র আজ তার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ থাকতে পারছে না। ব্যক্তির স্বার্থে হোক আর রাষ্ট্রের স্বার্থেই হোক প্রত্যেক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে তার কর্মপরিধি ক্রমান্বয়ে প্রসারিত করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। আজ রাষ্ট্রকে National interest ভুলে Global interest এর প্রতি সর্বাধিক প্রাধান্য দিতে হচ্ছে, যে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আজ শুধুমাত্র সনাতন পদ্ধতির মধ্যে আবদ্ধ নেই। বর্তমানে পুঁজিবাদী আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কর্মপরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হওয়ার কারণসমূহ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সামগ্রিক আলোচনা মূলত রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। আধুনিক সময়ে রাষ্ট্রের কর্মপরিধি এত ব্যাপক হচ্ছে যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা বৃদ্ধির কারণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. নতুন ধারণার উদ্ভব: বর্তমানে অনেক নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব হয়েছে। সে সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পূর্বে শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করতো। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র, সংবিধান ও নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে নতুন নতুন ধারণার বিকাশ ঘটেছে। এগুলোর উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধিকেই সম্প্রসারিত করেছে।

২. সামাজিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আবির্ভাব মূলত সামাজিক বিজ্ঞান থেকে। বর্তমানে সামাজিক বিজ্ঞানের কর্মপরিধি এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়, বর্তমানে এর কর্মপরিধি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। যে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩. আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন: আদিম যুগে তথা গ্রিসের সমাজব্যবস্থায় মানুষের আর্থসামাজিক কার্যকলাপ ছিল প্রধানত গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টাকে কেন্দ্র করে। বর্তমান সময়ে মানুষের আর্থসামাজিক কার্য পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কথা না ভেবে সমগ্র বিশ্বের স্বার্থের কথা ভাবতে হচ্ছে, যে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৪. রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন: বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক অবস্থায় একটা গতিশীলতা বিদ্যমান। বলা যায়, প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। সে কারণে পরিবর্তিত বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থার সাথে তাল রেখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।

৫. রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার পরিসমাপ্তি: বর্তমানে গতানুগতিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার পরিবর্তে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর আলোচনা শুরু হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার ক্ষেত্রে সামাজিক মনস্তত্ত্ব, বাক্তিকেন্দ্রিক সমাজতত্ত্ব, সামাজিক ভাষাতত্ত্ব ও সামাজিক নৃতত্ত্বের গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। এভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি ব্যাপক হচ্ছে।

৬. জ্ঞানের পরিধির সম্প্রসারণ: বর্তমানে জ্ঞানের পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাও ব্যাপক হয়েছে। তাই বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ে আলোচনা করে না। নতুন নতুন বিষয় বা তত্ত্ব নিয়েও আলোচনা করে।

৭. বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন: কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ছাড়া কার্যত সে রাষ্ট্রের সার্বিক কার্যাদি অচল হয়ে পড়ে। তবে সময়ের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তিত হয়। যেমন- বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, “We want friendship to all malies to none.” অর্থাৎ, তাঁর বৈদেশিক নীতি ছিল, সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কারো সাথে শত্রুতা নয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ অনেকটা প্রতিষ্ঠিত বলে সরকার দাবি করে, যে কারণে তারা দাতাগোষ্ঠীর আস্থার সাথে কথা বলতে পারে। এজন্য বলা যায়, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি পরিবর্তিত হচ্ছে।

৮. অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানো: বর্তমানে প্রত্যেকটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটাতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হচ্ছে। যেমন- বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ চাহিদা (খাদ্য) মিটাতে গিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যেমন নতুন নতুন প্রত্যয় যোগ হচ্ছে, তেমনি তার পরিধি প্রসারিত হচ্ছে।

৯. নতুন সমস্যা সমাধান: সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের আন্তঃক্রিয়ার কোন সীমা পরিসীমা নেই। মানুষ আজ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের তথা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। এ ধধ্বংসাত্মক ক্রিয়ার ফলে মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যে কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রতন্ত্রকে এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হচ্ছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় নতুন নতুন অধ্যায় সংযোজিত হচ্ছে।

১০. আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রভাব: বর্তমান সময়ে নাগরিক জীবন বহুমুখী আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, যে কারণে আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ রাষ্ট্রীয় জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করছে। আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১১. তুলনামূলক রাজনীতির অধ্যয়ন: বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বিভিন্ন তুলনামূলক রাজনীতির অধ্যয়ন করতে হচ্ছে। তুলনামূলক রাজনীতি অধ্যয়ন তথা বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো চিহ্নিতকরণ ও তার প্রতিকার বিধানের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সৃষ্টির আদিকাল থেকে সভ্যতা নিয়ত পরিবর্তনশীল। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক বিশ্ব এ পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সদা সচেষ্ট। যে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অতীত ও বর্তমান সময়ে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এর পরিধি প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে বৃদ্ধি করে, যা Ultimately রাজনৈতিক বিজ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত করে।