অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের গতানুগতিক পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের গতানুগতিক পদ্ধতি বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: বর্তমানে বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়। এর ফলেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভিন্ন অনুসন্ধান পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। কোন পদ্ধতিকেই সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত বলা যায় না। সেই প্লেটো- এরিস্টটলের আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিভিন্ন অধ্যয়ন পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতিসমূহকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: সনাতন/গতানুগতিক পদ্ধতি এবং আধুনিক পদ্ধতি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের সনাতন বা গতানুগতিক পদ্ধতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের সনাতন পদ্ধতিগুলো মূলত আদর্শবাদী পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। নিম্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের সনাতন বা গতানুগতিক পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. ঐতিহাসিক পদ্ধতি (Historical method): অতীতের জ্ঞান এবং বর্তমানের পর্যালোচনা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী আলোচনার পথ প্রশস্ত করে। রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃতি জানতে হলে তাদের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনের ধারা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। ঐতিহাসিক পদ্ধতির মাধ্যমে এ ধারণা লাভ করা যায়। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্র অতীতে কেমন ছিল এবং কিভাবে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে, সে বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করে তা ব্যাখ্যা করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Pollock এর ভাষায়, “The historical method seeks an explanation of what institutions are tending to be, more in the knowledge of what they have been and how they, came to be, what they are, than in the analysis of then as they stand.”
২. পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি (Observational method): রাজনৈতিক বিষয়সমূহের যথাযথ অনুশীলনের জন্য
পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি অবলম্বনের উপর Lord Bryce, Lowell প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন, প্রকৃতি, কার্যাবলি যথাসম্ভব ব্যাপক ও নিরপেক্ষ দুরিতে পর্যবেক্ষণ করলে কতকগুলো সাধারণ সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাধারণ তত্ত্বের মর্যাদা লাভ করতে পারে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ সুচারুরূপে সম্ভব হতে পারে।
৩. পরীক্ষামূলক পদ্ধতি (Experimental method): রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোতে উপযুক্ত ধরনের সরকার গঠনের জন্য গবেষণা চালানো হয়। তাছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যালোচনা এক অর্থে নতুন নতুন আইনকানুন, ন্যায়নীতির ধারণা এবং তত্ত্ব ও দর্শনের পরীক্ষামূলক আলোচনা মাত্র। এ ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল অসন্তোষজনক প্রতিপন্ন হলে তা পরিহার করা হয় এবং সন্তোষজনক হলে অন্যান্য দেশে প্রয়োগের কথা বলা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে অসুবিধা হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের উপাদানসমূহ সদা পরিবর্তনশীল, সচেতন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।
৪. দার্শনিক পদ্ধতি (Philosophical method): রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় দার্শনিক পদ্ধতির প্রবক্তাদের মধ্যে প্লেটো, রুশো, টমাস মার, বেস্থাম, হেগেল, কান্ট, হবস্, গ্রিন, ব্রার্ডলে প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ পদ্ধতি অনুসারে কতকগুলো বিষয়কে অনুমানের ভিত্তিতে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয় এবং অবরোহ পদ্ধতি (Deductive method) তে কতকগুলো সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজন, প্রকৃতি, কার্যাবলি, এর আদর্শ, ব্যক্তির সাথে তার সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে মীমাংসা দার্শনিক পদ্ধতিতে করা হয়।
৫. তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative method): এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করা হয় এবং তুলনামূলক আলোচনার ভিত্তিতে কার্যকারণ সূত্র নির্ধারণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে অতীত এবং বর্তমানের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেও তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। কোন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি এ পদ্ধতিতে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। তবে এ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তুলনীয় রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। অন্যথায়, উপনীত সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হতে বাধ্য। Aristotle ১৫৮টি City state এর তুলনামূলক বিশ্লেষণের দ্বারা তাঁর রাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছিলেন।
৬. আইনমূলক পদ্ধতি (Juridical method): এ পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রকে একটি আইনমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। আইনমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইন প্রণয়ন ও আইন কার্য করার মাধ্যমেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হয়। Prof. Gettell এর ভাষায়, “The juridical or legalistic method regards the state as a legal person or corporation existing for the creation and enforcement of law.” রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আইনমূলক অধ্যয়ন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
৭. জীববিজ্ঞানমূলক পদ্ধতি (Biological method): জীবদেহের সাথে সাদৃশ্যমূলক আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের গঠন, ক্রমবিকাশ, বিবর্তন, কার্যাবলি ইত্যাদি ব্যাখ্যা করাই এ পদ্ধতির মূখ্য উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের ক্ষেত্রেও এ ধরনের সাদৃশ্যমূলক আলোচনার সার্থকতা অতিমাত্রায় সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনেক সময় ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্তের সৃষ্টি করে।
৮. অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি (Empirical method): আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যয়নে এ পদ্ধতি প্রয়োগের এক বিশেষ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। অত্যাধুনিক আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণই (Behaviouralists) অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে থাকেন। সাম্প্রতিক কালে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কলাকৌশল অবলম্বন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পর্যালোচনার যে প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে তারই ফলশ্রুতি হিসেবে এ পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান – অনুশীলনের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতার সাহায্য নেয়া হয়।
৯. সাক্ষাৎকার পদ্ধতি (Interview method): বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের নিকট থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করা যায়। তাই বর্তমানে এ পদ্ধতি খুবই জনপ্রিয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান মানুষকে সুখী, সমৃদ্ধশালী, সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে সহায়তা করে। এ জ্ঞান মানুষকে রাজনৈতিক ও উদারতার শিক্ষা দেয় ফলে ব্যক্তির সকল সংকীর্ণতা দূর হয় এবং মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয়। সুতরাং ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের উপকারিতা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।