রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের আধুনিক পদ্ধতি আলোচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের আধুনিক পদ্ধতি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের আধুনিক পদ্ধতিগুলো বর্ণনা কর।

অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের আধুনিক পদ্ধতিসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তাই সামাজিক বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি, বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ মাত্রেই রাষ্ট্রীয় জীব। যারা রাষ্ট্রীয় আওতার বাইরে, তাদের স্থান মানবসমাজের উপরে বা নিচে।” মনীষী বেকনও অনুরূপ উক্তি করেছেন, “নির্জনতা যারা কামনা করে, তারা হয় দেবতা না হয় পশু।” সুতরাং রাষ্ট্র ছাড়া কারও পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের আধুনিক পদ্ধতি: নিম্নে রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের আধুনিক বা আচরণবাদী পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হলো:

১. আচরণবাদী পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি (Behavioural approach): রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের আধুনিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে আচরণবাদ অন্যতম। পরীক্ষালব্ধ ও প্রায়োগিক তত্ত্ব উদ্ভাবন, সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ ও তাদের সত্যাসত্য যাচাইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সুসমন্বিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুসন্ধানই হলো আচরণবাদ’। এ পদ্ধতি অনুসারে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গঠন করে সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের কথা বলা হয়। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচরণকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যাখ্যা করাই হচ্ছে আচরণবাদের প্রধান লক্ষ্য। আচরণবাদের বৈশিষ্ট্য হলো আন্তঃসমাজবিজ্ঞান কেন্দ্রিক আলোচনা, তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার বিরোধিতা করা এবং অভিজ্ঞতাবাদী রাজনৈতিক তত্ত্ব গঠন ইত্যাদি।

২. ব্যবস্থা তত্ত্ব (System theory): আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞানে যেসব নতুন এবং যুগান্তকারী পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে তাদের সবগুলোই বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে। এ আধুনিক পদ্ধতিগুলোর অন্যতম হিসেবে ব্যবস্থা বিশ্লেষণ (System analysis) তত্ত্ব একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো এবং কার্যাবলির বিন্যাসপূর্বক ঐ ব্যবস্থার সামগ্রিক পর্যালোচনা করে। ব্যবস্থা তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা হলেন ডেভিড ইস্টন (David Easton)। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘The Political System’ এ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এর সামগ্রিক পরিবেশের প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলত ইনপুট-আউটপুট সম্পর্কিত আলোচনা, যার সাথে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম জড়িত।

৩. গোষ্ঠীতত্ত্ব (Group theory): আধুনিক কালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সংঘ বা গোষ্ঠীতত্ত্বের বহুল প্রয়োগ লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাথমিক কৃতিত্ব আর্থার বেন্টলী (Arthur Bently) এর। তিনি তাঁর ১৯০৮ সালে প্রকাশিত The Process of Government: A Study of Social Presures’ গ্রন্থে এ’ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। যাটের দশকে ডেভিড ট্রুম্যান (David Truman), ডি, ৩. কি (V.O.Key), বারট্রাম লাগাম (Bertram Latham) প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটান। এ মতবাদ অনুযায়ী সমগ্র সামাজিক জীবনের সব স্তরকেই সক্রিয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর কার্যাবলির আলোকে বর্ণনা করা যেতে পারে। গোষ্ঠী মতবাদের ভিত্তি হলো গোঠীর অভ্যন্তরীণ সংগঠন ও কার্য প্রক্রিয়া। এ মতবাদের অনুসারীদের মতে, সমাজ অসংখ্য গোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত। প্রত্যেক গোষ্ঠীই একে অপরের সাথে অব্যাহতভাবে ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত থাকে। এরূপ সকল গোঠাই সরকারের কাছে তাদের দাবিদাওয়া উত্থাপন করে। সরকার অন্যান্য গোঠী হতে এখানেই পৃথক যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থকামী গোষ্ঠীর অব্যাহত স্বার্থের সমস্যা মোকাবিলার উপায় উপকরণ সরকারের রয়েছে।

৪. কাঠামো-কার্যগত দৃষ্টিভঙ্গি (Structural-functional approach): আধুনিক কালে কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় তত্ত্ব। এ পদ্ধতির অন্যতম প্রবক্তা হলেন Prof. G. A. Almond ও তাঁর কয়েকজন অনুসারী। বিশেষত ১৯৬০ সালে প্রকাশিত Almond and James Coleman সম্পাদিত ‘The Politics of the Developing Areas’ গ্রন্থটি তত্ত্বের বিকাশে মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তীতে Gabrial Almond Bingham Powell তাঁদের ‘Comparative Politics: A Developmental Approach’ গ্রন্থের মাধ্যমে তত্ত্বটির সর্বাধিক বিকাশ সাধন করে।

Almond and Powell এর মতে, “By structure we mean the observable activities which make up the political system” তাঁদের মতে, “মানুষের রাজনৈতিক কার্যকলাপ বলতে আমরা রাজনৈতিক কার্যাবলিতে জড়িত হতে পারে এমন ব্যক্তির সকল কার্যাবলিকেই বুঝি না, বরং তার কার্যকলাপের সে অংশকেই বুঝি, যা রাজনৈতিক। প্রক্রিয়াতে জড়িত।” উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আইনসভা হলো ‘কাঠামো’ এবং আইন প্রণয়ন হলো ‘কার্য’। Almond and Powell এ তত্ত্বের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতি সুষ্ঠুভাবে বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের জন্য রাজনৈতিক কাঠামো ও কার্যকলাপের বিশ্লেষণ করে তুলনামূলক রাজনীতি (Comparative politics) পর্যালোচনার সূত্রপাত করেছেন।

৫. যোগাযোগ তত্ত্ব (Communication theory) : রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের একটি আধুনিক পদ্ধতি হলো যোগাযোগ তত্ত্ব। জার্মান দার্শনিক Karl Deutsch তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘The Nerves of Government’ নামক গ্রন্থে এ তত্ত্বটির অবতারণা করেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব সংরক্ষণ, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, রাজনীতিতে কাঠামোগত প্রভাব ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা হয়। এ মতবাদের অনুসারীদের মতে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বারা সীমাবদ্ধ।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান মানুষকে সুখী, সমৃদ্ধশালী, সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে সহায়তা করে। এ জ্ঞান মানুষকে রাজনৈতিক ও উদারতার শিক্ষা দেয় ফলে ব্যক্তির সকল সংকীর্ণতা দূর হয় এবং মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয়। সুতরাং ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্পর্কে সঠিক জান লাভের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের উপকারিতা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।